Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

এ আলো ছড়িয়ে পড়ুক

Icon

আজিজুল রমিজ

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এ আলো ছড়িয়ে পড়ুক

ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী ৮০ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়ে ২০টি শিশুকে আগুনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচিয়ে নিজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। এ ঘটনা শুধু মানবিক নয়, দৃষ্টান্তনীয়। এ ঘটনা শিক্ষকতাকে এক পরম ত্যাগের উচ্চ মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছে। একজন শিক্ষক কেবল জ্ঞানই দেন না, প্রয়োজনে যে জীবনও দেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, মাহরীন আমাদের সেই সত্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন। শ্রেণিকক্ষে তার পরিচয় যতটা গুরুত্বপূর্র্ণ, সংকটের সময় তার নৈতিক অবস্থান ততটাই আলোকিত।

এ ঘটনা আমাদের ফিরিয়ে নেয় এক পুরোনো কিন্তু মৌলিক প্রশ্নে-শিক্ষক কে? কীভাবে তিনি একটি জাতিকে আলোকিত করতে পারেন?

এ অঞ্চলে একসময় শিক্ষকরা ছিলেন সমাজের সর্বাধিক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তারা পাঠদান করতেন, কিন্তু তাদের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল না পাঠ্যপুস্তকে। তারা গড়তেন বিবেকবান মানুষ। সমাজচিন্তার কারিগর ছিলেন তারা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এমন একজন শিক্ষক, যিনি নারীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ, ভাষার সংস্কার ও মানবিক দর্শনে একাই এক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। তার শিক্ষা পদ্ধতি ছিল বাস্তবঘনিষ্ঠ, সহানুভূতিশীল ও অন্তর্মুখী। তিনি শিক্ষার্থীদের পড়াননি শুধু, মানুষ করে তুলতে চেয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে শিক্ষা ছিল প্রকৃতি ও কল্পনার সঙ্গে এক সংলাপ। তার কাছে শিক্ষকতা ছিল ভালোবাসা ও মননের সমন্বয়। শিক্ষক ছিলেন পথপ্রদর্শক-নির্দেশক নন, অনুপ্রেরণার উৎস।

বাংলাদেশেও এ ধারা থেমে থাকেনি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বইয়ের আনন্দকে কেন্দ্র করে তরুণদের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তার উদ্যোগে তরুণরা শিখেছে জীবনকে ভালোবাসতে, আত্মবিশ্বাসে উঠে দাঁড়াতে ও স্বপ্ন দেখতে। ড. কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন বিজ্ঞানের চর্চা, যুক্তিবোধ ও স্বাধীন চিন্তার প্রবক্তা। তিনি বোঝাতেন-শিক্ষা মানে শুধু সনদ নয়, বরং আলো, প্রশ্ন আর সাহসের সংমিশ্রণ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধেও অসংখ্য শিক্ষক ছিলেন, যারা জীবন দিয়ে গড়েছেন জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের শিক্ষাচিন্তা হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের হাতিয়ার। এসব উদাহরণ মনে করিয়ে দেয়-শিক্ষক শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন না, তিনি সময় নির্মাণ করেন, বিবেক জাগান।

তবে আজকের বাস্তবতায় আমরা এক ভিন্ন চিত্রও দেখছি। কোথাও শিক্ষক অপমান করছেন শিক্ষার্থীকে, কোথাও তার চোখে অনুপস্থিত ভালোবাসা ও সহানুভূতি। কেউ কোচিং বাণিজ্যে জড়িত, কেউ রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায়, আবার কোনো কোনো শিক্ষক নিজেই নিঃশব্দে নিগৃহীত-সব মিলিয়ে শিক্ষকতা অনেক জায়গায় সেবামূলক অধ্যবসায় থেকে এখন যান্ত্রিক পেশায় পর্যবসিত হয়েছে।

এর পেছনে কিছু বাস্তব কারণ রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষকতার সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অবজ্ঞা অনেককে শিক্ষকতায় নিরুৎসাহিত করে। দ্বিতীয়ত, নিয়োগ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব। মেধার চেয়ে ঘুস ও রাজনৈতিক পরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি; ফলে পেশার প্রতি আস্থা হারান অনেক শিক্ষক। তৃতীয়ত, পাঠ্যক্রমে নেই প্রশ্ন করার স্বাধীনতা। মুখস্থনির্ভরতা ও পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা শিক্ষকের সৃজনশীল ভূমিকাকে বাধাগ্রস্ত করে। চতুর্থত, কোচিং বাণিজ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ককে মানবিক জায়গা থেকে টেনে এনেছে অর্থনৈতিক লেনদেনের মাটিতে। তবু এ অন্ধকারে কিছু আলোর রেখা আছে। আজও কিছু শিক্ষক আছেন, যারা নিজের খরচে শিক্ষার্থীকে বই দেন, টিফিন কিনে দেন, এমনকি ছুটির দিনেও শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর রাখেন। তাদের সামাজিক স্বীকৃতি না থাকলেও তারা নীরবে জাতি গড়ছেন।

মাহরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ সেই আলোকবর্তিকারই প্রতিফলন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি প্রথমে ভেবেছেন তার শিক্ষার্থীদের কথা। এমন আত্মদান রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার যোগ্য। এখন সময় শিক্ষকতা পেশাকে কাঠামোগতভাবে পুনর্গঠনের। নিয়োগ ব্যবস্থা হতে হবে স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক। শিক্ষকের বেতন, প্রশিক্ষণ ও মর্যাদা বাড়াতে হবে। পাঠ্যক্রমে যুক্ত করতে হবে নৈতিকতা, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ ও মানবিকতা। শিক্ষক সংগঠনগুলোকে মুক্ত করতে হবে দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে। এ দায় শুধু সরকারের নয়। অভিভাবক, শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকেও ভাবতে হবে-কীভাবে আমরা এমন শিক্ষক গড়ব, যাদের দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভরসা পাবে।

মাহরীন চৌধুরীর এ আত্মত্যাগ যেন আমাদের প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়-শিক্ষক পুড়ে যান জাতিকে আলোকিত করতে। তার আলো ছড়িয়ে পড়ুক আগামী দিনে।

আজিজুল রমিজ : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

ঘটনাপ্রবাহ: উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম