যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাপ
এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান, আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের কণ্ঠস্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয় ১৯৫৭ সালের ২৬ জুলাই। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেই ন্যাপ গঠন করেছিলেন।
২০২৫ সালে ২৬ জুলাই সেই ন্যাপের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সেই সময়ে ভাসানী পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনার পক্ষে ছিলেন। এ মতভেদের কারণে, ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। ন্যাপ মূলত বাম বা ডান নয়, মধ্যপন্থি এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। বস্তুত আওয়ামী লীগ আদর্শিক কারণে বিভক্ত হয়ে পড়ায় ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নতুন দল গড়ার দিকে মনোনিবেশ করলেন? এ বিষয়ে রাজনীতিক ও কবি বুলবুল খান মাহবুব তার ‘মওলানা ভাসানী-অনন্য ব্যতিক্রম’ নিবন্ধে লিখেছেন : মওলানা ভাসানীর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি প্রায় সবসময়েই কোনো না কোনো পার্লামেন্টারি দলের সঙ্গে সংযুক্ত থেকেছেন; কিন্তু কখনোই জনতার স্বার্থের চেয়ে দলের স্বার্থ তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি। তাই যে মুহূর্তে তার দল ক্ষমতার মোহে জনতার স্বার্থের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সেই মুহূর্তেই তিনি তার প্রাণপ্রিয় সংগঠনকে ছিন্ন বস্ত্রের মতো ত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি।
বহু বছরের ত্যাগের বিনিময়ে ক্ষমতা দখলের পর সংগঠনের সুদিনে যখন একটু অবসর নেওয়ার পালা, সেই মুহূর্তে জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদে আবার নতুন করে জনতার দাবি নিয়ে তাকে নতুন বিরোধী দলের জন্ম দিতে হয়েছে মওলানা ভাসানীকে। বহু তথাকথিত দেশপ্রেমিক নেতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিরোধী দলের নেতা হিসাবে যে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজের জীবনে বারবার লাঞ্ছনা ভোগ করেছেন, দীর্ঘদিন সংগ্রামের পর ক্ষমতা দখল করে অতীতের অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে জনতা এবং তার বিরোধীদের ওপর তিনি তার পূর্বসূরিদের একই কায়দায় অত্যাচার চালাচ্ছেন।
কিন্তু মওলানা ভাসানী তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এ কপটতাকে স্বীকার করতে পারেননি-জনগণ এবং তাদের সুখ-দুঃখ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেননি বলেই তাকে দু’তিনবার নিজের হাতে গড়া সংগঠন ত্যাগ করতে হয়েছে। নিজের দীর্ঘদিনের দুঃসময়ের সহকর্মীরা যখন ক্ষমতায় গিয়ে জনতার কথা ভুলে গেছে, তখন নিজের হাতে গড়ে তোলা কর্মীদের ত্যাগ করে নতুন কর্মী সৃষ্টি করার কাজে নতুন করে আত্মনিয়োগ করেছেন। জনতার স্বার্থে নিজ দলের বিপক্ষেও ভোট দিতে কুণ্ঠিত হননি মওলানা ভাসানী। যে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য একদিন তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন; সেই পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ বাজেট অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে তিনি নিজ দলের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে বলেছেন, আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম?
মুসলিম লীগ সরকারের অপকৃর্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুসলিম লীগ সরকারের জেল-জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে সদ্য প্রতিষ্ঠিত দলটিকে প্রদেশব্যাপী জনপ্রিয় করেছেন। ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর দলের কাউন্সিল অধিবেশনে দলটিকে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসাবে গড়ে তুলতে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করেছেন।
এখানে উপলব্ধি করার বিষয় যে, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে নয়; সুসময়ে দল ছেড়েছেন। যে দলটির তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিই নন, দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি এ দলটিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব অঞ্চলে, সব সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তুলেছিলেন। সেই দল পরিত্যাগ করার সময় তিনি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন বৈকি! কিন্তু আদর্শের কাছে আপস করা তার ধাতে ছিল না।
১৯৫৭-র ২৫ জুলাই মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তিনি তার দীর্ঘ লিখিত ভাষণে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে নতুন দল গঠনের পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করেন। কৃষিপ্রধান পাকিস্তানের কৃষকের সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার দশ বছর পরও দেশের কৃষক সমাজ স্বাধীনতার কোনো আস্বাদন পায়নি। তারা আজ ভুখা।’ শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধে সরকারের নিন্দা করে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত, তারা কোনো আন্দোলন করতে গেলে তাদের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতি।’ তিনি তার ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, পররাষ্ট্রনীতি ও বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কেই তিনি বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যোগ দিয়েছিলেন পাক-ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপকথার নায়ক সীমান্ত প্রদেশের লালকোঠা নেতা সীমান্ত গান্ধী খান, আবদুল গাফ্ফার খান, পাঞ্জাবের জননেতা মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, সিন্ধুর জননেতা ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান জিএম সৈয়দ, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী, বেলুচিস্তানের আবদুস সামাদ খান আচাকজাই, খান আবদুল ওয়ালী খান, পাঞ্জাবের মেজর ইসহাক, ব্যারিস্টার মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী, আফজল খান, প্রিন্স আবদুল করিম, গাউস বকস বেজেঞ্জো, খায়ের বকশ মারী, আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল, আবরার আবদুল গফুর, আবরার সেকেন্দর খান, গোলাম মোহাম্মদ লেঘারী, হাশিম খান গিলয়াই, এয়ার কমান্ডার জানজুয়া, আবদুল মজিদ সিন্ধী প্রমুখ। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি ব্রড বেইজড পার্টি হিসাবে জন্ম নেয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সংক্ষেপে ন্যাপ। পার্টির নীতি ও আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। চূড়ান্ত লক্ষ্য সমাজতন্ত্র।
১৯৫৭ সালের ডিসেম্বরে ন্যাপের উদ্যোগে ব্রহ্মপুত্র নদের চরে ফুলছড়িতে কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করা হয় এবং ওই সম্মেলনে ‘কৃষক সমিতি’ গঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করেন। বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের দাবিতে মওলানা ভাসানী কারাগারে আমরণ অনশন শুরু করেন। মওলানা ভাসানীর আহ্বানে সর্বদলীয় প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১৯৬৪ সালের ১৮ মার্চ সর্বজনীন ভোটাধিকার দিবস পালিত হয়। ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ন্যাপ সংযুক্ত বিরোধী দলে প্রার্থী হিসাবে মিস ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনি প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে।
এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া : কলাম লেখক, রাজনীতিককর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
gmbhuiyan@gmail.com
