নিউইয়র্কের চিঠি
অভিবাসীদের দুঃস্বপ্ন ও কয়েকটি ঘটনা
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যে তার দ্বিতীয় মেয়াদের ছয় মাস কাটিয়ে দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে তার প্রশাসন বেশকিছু ফেডারেল প্রতিষ্ঠান থেকে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় লোক ছাঁটাই এবং অভ্যন্তরীণ শুল্কনীতির কারণে আমেরিকানদের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসীদের আটক এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে সামগ্রিকভাবে অভিবাসী কমিউনিটির আতঙ্কের পাত্রে পরিণত হয়েছেন ট্রাম্প। গ্রেফতার ও বহিষ্কার ভীতি বাংলাদেশি অভিবাসীদের মাঝেও আছে। কারণ অভিবাসন নীতি সম্পর্কিত ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, বৈধ অভিবাসীদের যারা অ্যাসাইলাম বা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে গ্রিনকার্ড পেয়েছেন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেছেন, যদি প্রমাণিত হয় যে, তারা তাদের অ্যাসাইলাম আবেদনে অসত্য তথ্য প্রদান করেছেন এবং তাদের আবেদনের সমর্থনে ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়েছেন, তাহলে তারা বহিষ্কৃত হতে পারেন।
ইমিগ্রেশন আইনজীবীদের মতে, এসবের সঙ্গে আরও কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে : যদি কোনো ন্যাচারালাইজ্ড নাগরিক আমেরিকার স্বার্থবিরোধী, ট্রাম্প প্রশাসনের বিরোধী কার্যকলাপ ও ইহুদি বিদ্বেষে তৎপর থাকেন, তাহলে তারা বিপদে পড়তে পারেন। অভিবাসীদের ন্যাচারালাইজ্ড প্রক্রিয়া নতুন করে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এতে সামান্য ত্রুটি পাওয়া গেলে নাগরিকত্ব বাতিল প্রক্রিয়া শুরু করবে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস।
ইমিগ্রেশন আইনজীবীরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ ধরনের অভিবাসনবিরোধী উদ্যোগকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে বর্ণনা করলেও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রিনকার্ডধারী কিছু অভিবাসীকে আটক করার ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটেছে। তাদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের এ মনোভাব ও পদক্ষেপ আমেরিকার সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক নাগরিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলছে। রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে রাষ্ট্র যদি কোনো নাগরিকের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে, তা কেবল অভিবাসন নীতির ওপরই নয়, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আঘাত করার শামিল। ন্যাচারালইজ্ড সিটিজেনশিপ বাতিল করার পদ্ধতি একটু জটিল ও মন্থর হলেও ট্রাম্পের পক্ষে কোনোকিছু করা অসম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা। ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যেখানে প্রতিবছর গড়ে নাগরিকত্ব বাতিলের মাত্র ১১টি করে মামলা হয়েছে, সেখানে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের দ্বিতীয় বছর ২০১৮ সালে নাগরিকত্ব বাতিলের মামলা করা হয়েছিল ১,৬০০টি।
তার এবারের অভিবাসন নীতি অতীতের যে কোনো সময়ের প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত নীতির চেয়ে কঠোর। সেজন্য বৈধ অভিবাসীরাও নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। কারণ যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ ছাড়াও জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকিমূলক, মানব পাচারে জড়িত থাকা এবং বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধ ঘটানোর মতো অপরাধ সংঘটনের প্রমাণ পাওয়া যাবে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারালাইজ্ড নাগরিক হলেও তাদের বিরুদ্ধে নাগরিকত্ব বাতিলের মামলা করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশি অভিবাসীরাও বিপদমুক্ত নন। তারাও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটাচ্ছেন। তবে খুব বেশিসংখ্যক বাংলাদেশির ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। ২০২০ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বৈধ-অবৈধ মিলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা দুই লাখের কম ছিল। গত সাড়ে পাঁচ বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দুই লাখের কিছু বেশি হতে পারে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রায় অর্ধেকই বাস করেন নিউইয়র্ক সিটিতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশি অভিবাসী বাস করেন ক্যালিফোর্নিয়ায়; যেখানে আনুমানিক ১৪ হাজার বাংলাদেশি আছেন।
তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নিউইয়র্কের প্রতিবেশী অঙ্গরাজ্য নিউ জার্সি; যেখানে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার বাংলাদেশি অভিবাসীর বসবাস। নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া দুটিই জনবহুল অঙ্গরাজ্য এবং উভয় অঙ্গরাজ্যই ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টি নিয়ন্ত্রিত। ট্রাম্প প্রশাসন এ দুটি অঙ্গরাজ্যে অবৈধ ইমিগ্রান্টদের গ্রেফতার কার্যক্রম জোরদার করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ইমিগ্রেশন সংস্থার এজেন্ট ছাড়াও ন্যাশনাল গার্ড ও মেরিন সেনাদের নিয়োগ করেছে।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ৪৩ জন অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীকে গ্রেফতার করেছে এবং ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আরও চারশ’ থেকে পাঁচশ’ বাংলাদেশি অভিবাসীর রেকর্ড যাচাই করছে বলে জানা গেছে। এসব বাংলাদেশি অভিবাসীর অনেকে দীর্ঘদিন থেকে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও তারা গ্রিনকার্ডধারী বা যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা নন। তাদের অধিকাংশের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অথবা ইমিগ্রেশন আদালতে বিভিন্ন পর্যায়ে বিবেচনাধীন রয়েছে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ ঘটানোর রেকর্ডও খুব বেশি নেই। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন বা ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের মামলা থাকলেও সেগুলো ‘গুরুতর অপরাধ’ হিসাবে গণ্য নয়।
অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। গত প্রায় দেড় দশকে নিউইয়র্কে তিনটি ঘটনায় তিনজন বাংলাদেশি অভিবাসী সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনকে ৩০ বছর, একজনকে ৫৫ বছর এবং আরেকজনকে ৪২ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। প্রথম ঘটনায় বাইশ বছর বয়সি বাংলাদেশি যুবক কাজী মুহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস এফবিআই’র (ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন) ‘স্টিং অপারেশন’ বা পাতা ফাঁদে পড়ে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল ২০১২ সালের অক্টোবরে। নাফিস আদালতে তার অপরাধ স্বীকার করেছিলেন। এক বছর পর ২০১৩ সালের নভেম্বরে আদালত তাকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। প্রকৃত ঘটনা ছিল, নাফিস একটি গাড়িতে প্রায় এক হাজার পাউন্ড ওজনবিশিষ্ট যে বোমাটি ম্যানহাটানে অবস্থিত নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের গেটের সামনে বিস্ফোরণ ঘটানো চেষ্টা করেন, সেটি সত্যিকারের কোনো বোমা ছিল না। এফবিআই তাদের সন্দেহভাজনদের যাচাই করতে এ ধরনের নকল বিস্ফোরক বা নকল অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে তাদের মনে বিশ্বাস জন্মায় যে, এগুলো প্রকৃত বিস্ফোরক বা প্রকৃত অস্ত্র। নাফিস অনুরূপ জালে ফেঁসে গিয়ে বর্তমানে দণ্ড ভোগ করছেন। নাফিস যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে এসেছিলেন পড়াশোনা করতে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটানে ব্যস্ততম পরিবহণ কেন্দ্র পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে বোমা হামলার চেষ্টা চালানোর দায়ে বাংলাদেশি অভিবাসী যুবক আকায়েদ উল্লাহকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ফেডারেল আদালত। পাশাপাশি তাকে আরও ৩০ বছরের সাজার রায় শোনান বিচারক। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে যাবজ্জীন কারাদণ্ডকে ২৫ বছর হিসাব করা হয়। ফলে আকায়েদ উল্লাহর দণ্ড দাঁড়ায় মোট ৫৫ বছর। ধারণা করা যায়, ৩১ বছর বয়স্ক আকায়েদ উল্লাহকে অবশিষ্ট জীবন কারাগারেই কাটাতে হবে। উল্লেখ্য, তিনি টাইমস স্কোয়ার সাবওয়ে স্টেশন থেকে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে যাওয়ার ভূগর্ভস্থ পথে নিজের বুকে বাঁধা ‘পাইপ বোমার’ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। বোমাটি ঠিকমতো বিস্ফোরিত না হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক না হলেও তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের (ইসলামিক স্টেট) তৎপরতা ও প্রচারণায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছিলেন।
তৃতীয় ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির এক নেতার পুত্র রিজভি আহমেদ সিজারকে (৩৬) সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ করার চেষ্টা ও তার বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন ডলার দুর্নীতির ফাইল সংগ্রহের জন্য এফবিআই’র দুজন সাবেক এজেন্টকে ঘুস প্রদানের অভিযোগে নিউইয়র্ক পুলিশ ২০১৩ সালে তাকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৫ সালের মার্চে নিউইয়র্কের এক আদালত তাকে ৪২ মাসের কারাদণ্ড এবং ঘুস গ্রহণকারী এফবিআই’র সাবেক এজেন্ট রবার্ট লাসটিককে ৫ বছর এবং অপর সাবেক এফবিআই এজেন্ট জোহানেস থালেরকে ৩০ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করে। এছাড়া ২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান হোজে সিটিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান তরুণ হাসিব বিন গোলাম রাব্বি (২৪) গুলি করে তার শিক্ষাবিদ বাবা-মাকে হত্যা করায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। এ ঘটনা পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়।
ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী অভিযান প্রবল হয়ে ওঠায় বাংলাদেশি অভিবাসীরা বহু বছর আগে সংঘটিত উল্লিখিত অপরাধের ঘটনাগুলো নতুন করে স্মরণ করছে। যদিও একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটি ঘটনার সম্পর্ক নেই। কিন্তু অপরাধ তো অপরাধই এবং কোনো নির্দিষ্ট কমিউনিটির সদস্যরা এ ধরনের অপরাধ সংঘটন করলে তা সমগ্র কমিউনিটির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং অন্যান্য কমিউনিটির লোকজন ভীতি ও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে যখন অবৈধ অভিবাসীদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দেয়, তখন এসব ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে সংশ্লিষ্ট দেশে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলার অফিসগুলোয় ভিসা ইস্যু করার ক্ষেত্রেও। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য আবেদনকারীদের আবেদন নাকচ করা হয় অথবা দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসতে আগ্রহী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সব প্রক্রিয়া শেষ করা সত্ত্বেও ভিসা না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে সক্ষম হয়নি। অন্যান্য ক্যাটাগরির ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রেও একই ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে আগমন করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক
