বিমান দুর্ঘটনায় ট্রমাগ্রস্ত শিশুদের পাশে দাঁড়াতে হবে
ব্রি. জে. (অব.) এইচ আর এম রোকন উদ্দিন
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পর আমাদের হৃদয় যখন শোকে ভারাক্রান্ত, তখন একটি বিষয় আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। এটি দৃশ্যমান নয়, কিন্তু এর অভিঘাত গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি। ছোট ছোট শিশুরা, আমাদের নিষ্পাপ সন্তানরা, এমন এক বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছে, যা কোনো শিশুর দেখা উচিত নয়। জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষ, পোড়া মরদেহ, রক্তাক্ত সহপাঠীদের আর্তনাদ এবং পরিচিত স্কুল প্রাঙ্গণে মৃত্যুর ভয়াল থাবা।
এ অভিজ্ঞতা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়, বরং তাদের কোমল মনের ওপর এক গভীর ক্ষত। এ ধরনের দৃশ্য শিশুদের মনে যে ভয় ও আতঙ্কের জন্ম দেয়, তা সহজে মুছে যায় না। যদি তাৎক্ষণিকভাবে তাদের মানসিক সহায়তা না দেওয়া হয়, তাহলে এ ট্রমা ধীরে ধীরে গভীর মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে। অবসাদ, আতঙ্ক, অস্বাভাবিক আচরণ, দুঃস্বপ্ন, এমনকি আত্মবিকাশেও চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। কাল যারা ছিল প্রাণবন্ত ও হাসিখুশি, আজ তারা হয়ে উঠতে পারে নিঃসঙ্গ, ভীত কিংবা হতাশাগ্রস্ত, যদি আমরা তাদের এ গভীর যন্ত্রণাকে অবহেলা করি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশু মানে শুধু আকারে ছোট মানুষ নয়। তাদের মানসিক গঠন ভিন্ন, তাদের অনুভূতি অতি সংবেদনশীল। তারা ভয়াবহতা দেখলে তা গভীরভাবে তাদের হৃদয়ে গেঁথে যায়। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু বা আহত অবস্থা প্রত্যক্ষ করা, নিজেকে অসহায় মনে করা-এসব বিষয় শিশুর মানসিক শান্তি ও নিরাপত্তার অনুভূতিকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে।
এটি একটি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা। সরকার, স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়ে অভিজ্ঞ শিশু মনোবিজ্ঞানী এবং ট্রমা কাউন্সেলর নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিটি শিশুর মানসিক অবস্থা মূল্যায়ন করে প্রয়োজন অনুযায়ী থেরাপি দিতে হবে। গ্রুপ কাউন্সেলিং, আর্ট থেরাপি, প্লে থেরাপি ইত্যাদি বিলাসিতা নয়, বরং একান্ত প্রয়োজন।
শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেন তারা শিশুর ট্রমার লক্ষণগুলো বুঝতে পারেন এবং ঘরে ও ক্লাসরুমে একটি সহানুভূতিশীল ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেন। এর বদলে নীরবতা কিংবা অবহেলা হবে চরম নিষ্ঠুরতা। দুর্ঘটনার পর যদি আমরা আরেকবার তাদের অবহেলা করি, তাহলে সেটি হবে জেনেশুনে আরেকটি অপরাধ।
আমরা যেন মনে রাখি, ভবন পুনর্র্নির্মাণ করা যায়, রাস্তা মেরামত করা সম্ভব হয়, কিন্তু একটি ভেঙে যাওয়া মন যদি সময়মতো সেবা না পায়, তাহলে তা কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হতে পারে না। আমাদের শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব কেবল সমবেদনা প্রকাশ নয় তাদের আরোগ্য, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের আশ্বাস দেওয়া। আমরা যেন উদাসীন না হই, এখনই পদক্ষেপ নিই, যাতে এ বিভীষিকা তাদের জীবনের চিরন্তন ছায়া না হয়ে দাঁড়ায়।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আজকের বিশ্বের অন্যতম জরুরি এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি বিষয় হিসাবে স্বীকৃত। এটি যে কারও জীবনে-যে বয়স, পেশা বা পরিবেশেই হোক না কেন-প্রভাব ফেলতে পারে। শারীরিক রোগ দেখা যায়, কিন্তু মানসিক আঘাত অনেক সময় অদৃশ্য থাকে, এর প্রভাব হয় দীর্ঘস্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী। সময়মতো যত্ন না নেওয়া হলে এ মানসিক চাপ ধীরে ধীরে গুরুতর মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে, যা ব্যক্তির জীবনমান, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক, কাজের দক্ষতা এবং সামগ্রিক সুস্থতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার পেছনে বিভিন্ন কারণ কাজ করে। দুর্ঘটনা, প্রিয়জন হারানো, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, যুদ্ধ বা সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চাকরি হারানো বা বৈবাহিক বিচ্ছেদ। এসব ঘটনার কারণে মানসিক আঘাত তৈরি হতে পারে। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য স্কুলের চাপ, পারিবারিক কলহ, অবহেলা, বা সহপাঠীদের দ্বারা বুলিং মানসিক যন্ত্রণার উৎস হতে পারে। কখনো কখনো ছোট ছোট ঘটনা, যদি তা বারবার ঘটে বা আবেগপ্রবণ সময়ে ঘটে, তবুও তা দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা সৃষ্টি করতে পারে।
যদি এসব মানসিক আঘাত যথাযথভাবে ও সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়, তবে তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। প্রাথমিকভাবে মানুষ উদ্বেগ, মেজাজ পরিবর্তন, রাগ, দুঃস্বপ্ন এবং ঘুমের সমস্যা অনুভব করে। পরে এটি দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতা (ডিপ্রেশন), ট্রমা-পরবর্তী মানসিক রোগ (PTSD) এবং আতঙ্কজনিত সমস্যায় (panic disorder) পরিণত হতে পারে। শরীরেও এর প্রভাব পড়ে। দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি, মাথাব্যথা, হজমে সমস্যা, এমনকি হৃদরোগও দেখা দিতে পারে। কারণ মন ও শরীর একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এ ছাড়াও মানসিক আঘাত মানুষের চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। এতে স্মৃতি, মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস পায়। দৈনন্দিন কাজ করতে কষ্ট হয়। আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দেয়। নিরাশা, ভয়, অপরাধবোধ ইত্যাদি মাথাচাড়া দেয়। ফলে সম্পর্কেও টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। পরিবার, বন্ধু, সহকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়।
তবে মানসিক আঘাত যতই গভীর হোক, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হলো সমস্যাটিকে স্বীকার করা এবং সাহস করে সাহায্য চাওয়া। এক্ষেত্রে কাউন্সেলিং ও মনোচিকিৎসা পদ্ধতিগুলো খুবই কার্যকর, যেমন-কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT), মাইন্ডফুলনেস এবং স্ট্রেস ব্যবস্থাপনা চর্চা মানুষকে নেতিবাচক চিন্তা থেকে মুক্ত হতে এবং ইতিবাচকভাবে জীবনকে দেখতে সাহায্য করে। জটিল পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ প্রয়োগও দরকার হতে পারে। তবে শুধু চিকিৎসা নয়, পরিবারের ভালোবাসা, সহানুভূতি ও ধৈর্য মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত মানুষকে দ্রুত সুস্থ করে তুলতে পারে।
জীবনযাত্রার পরিবর্তনও মানসিক সুস্থতার জন্য জরুরি। নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম আহার, পর্যাপ্ত ঘুম ও প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো মানসিক ভারসাম্য ধরে রাখতে সাহায্য করে। শখের কাজ, সৃজনশীলতা, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক অনুশীলন মানুষকে ভেতর থেকে শক্তি জোগায়। পাশাপাশি স্কুল, অফিস ও সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে সবাই শুরুতেই সমস্যার লক্ষণ বুঝতে পারে এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কোনো লজ্জার বিষয় নয়, এটি মানুষের জীবনের ঝড়ঝঞ্ঝার একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এটি চিকিৎসাযোগ্য, প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফিরে আসা সম্ভব। সঠিক যত্ন ও সহানুভূতির মাধ্যমে একজন মানুষ ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারে এবং স্বাভাবিক, সুন্দর ও পূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সামাজিক দায়িত্বও।
সাম্প্রতিক ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনাটি জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। যে শিশুদের মুখে ছিল স্বপ্ন, তাদের অনেকেই আজ আহত, আতঙ্কগ্রস্ত বা চিরতরে হারিয়ে গেছে। যেসব শিশু দুর্ঘটনাস্থলে ছিল বা তাদের বন্ধু-বান্ধব হারিয়েছে, তাদের মানসিক যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। এ ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তাদের মনোজগতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে, যা যথাযথ মানসিক চিকিৎসা ও স্নেহ-ভালোবাসা না পেলে সারা জীবন তাদের তাড়া করে ফিরতে পারে।
এ দুঃসময়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে থাকা কিছু রাষ্ট্রবিরোধী গোষ্ঠী সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে গুজব ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। তারা দুর্ঘটনার ভয়াবহতা ও মানুষের আবেগকে পুঁজি করে সরকারের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য, ভুল তথ্য ও চক্রান্তমূলক গল্প ছড়াচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই-রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করা, জনগণের আস্থা নষ্ট করা এবং জাতিকে বিভাজনের পথে ঠেলে দেওয়া।
এমন অবস্থায় আমাদের সবার উচিত অত্যন্ত সচেতন ও সংযত থাকা। গুজব ছড়ানো এবং উসকানি দেওয়া এ অপশক্তিদের চিনে রাখা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের সম্পর্কে তথ্য দেওয়া নাগরিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মনে রাখতে হবে, আজ যদি আমরা তাদের মুখোশ উন্মোচন না করি, কাল তারা আরও বড় অঘটন ঘটাতে পারে।
এখন সময় ধৈর্যের, সহানুভূতির এবং দায়িত্বশীলতার। জাতীয়ভাবে আমরা যদি গুজব ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই এবং একইসঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক সুস্থতার দিকে মনোযোগ দিই, তাহলেই এই ট্র্যাজেডিকে একদিনে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি না করে শিক্ষা ও ঐক্যের প্রতীকে পরিণত করা যাবে। আসুন, ধৈর্য রাখি, প্রার্থনা করি, গুজব রোধ করি এবং শিশুদের পাশে দাঁড়াই।
ব্রি. জে. (অব.) এইচআরএম রোকন উদ্দিন : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
