Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি এবং কিছু প্রশ্ন

Icon

বদরুল হুদা

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি এবং কিছু প্রশ্ন

বিশ শতকের মার্কিন নারী লেখক এম কে রলিংসের ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। এখানে জেরি নামের ১২ বছরের এক শিশু লেখকের জ্বালানি কাঠ জোগাড় করার দায়িত্ব নেয়। বয়স কম হওয়ায় লেখকের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জেরি কাজটি করতে চায়। উপায়হীন হয়ে কাঠ চেরাইয়ের জন্য লেখক তাকে একটি কুঠার দেন।

একদিন কাঠ চেরাই করতে গিয়ে কুঠারটি ভেঙে গেলে জেরি নিজেই কুঠার ভাঙার দায় নেয়, যদিও লেখক ভালো করেই জানতেন জেরির এতে কোনো দোষ ছিল না। আমাদের দেশে না আছে সেই রকম ঘটনা, না আছে জেরির মতো সেই সততা, মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতা। এ দেশে যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন আত্মপক্ষ সমর্থন বা নিজের সাফাই গাওয়া নিয়ে আমরা ব্যস্ত।

সাহিত্য ছেড়ে বাস্তবের কয়েকটি উদাহরণ টানা যাক। চলতি বছরের মার্চে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণকালে ভুলক্রমে বোমা ড্রপ হওয়ায় কিছু লোক আহত এবং অনেক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিমানবাহিনী প্রধান সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেন। আমাদের দেশে ওসব তো ভাবা অন্যায়! এদেশে ‘ক্ষমা একটি মহৎগুণ’ বাক্যটি পাঠ্যপুস্তকের পাতায় শোভা পায়। ‘ক্ষমা’ শব্দটি না আছে কোনো ব্যক্তির অভিধানে, না আছে কোনো সরকারের নথিতে। এই লেখক যখন নিবন্ধ লিখতে বসেছেন, তখন পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩৫ এবং আহতের সংখ্যা অন্তত ১৬৫ জন বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

গত ২১ জুলাই ক্লাস চলাকালে যুদ্ধবিমানটি স্কুল ভবনে হঠাৎ আছড়ে পড়াতে বিস্ফোরণ-আগুনে পুড়ে ঝলসে ছাই হয়ে চলে গেল ৩৫টি জীবন, খালি হলো মা-বাবার কোল, স্বপ্ন ভেঙে হলো চুরমার। এ দুর্ঘটনা থেকে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিচ্ছে কিছু প্রশ্ন এবং সেই প্রশ্নের ভেতরে উঁকি দিচ্ছে এর কিছু দায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ যে কামরায় ক্লাসের জন্য শিক্ষার্থীদের বসার স্থান নির্ধারণ করেছে, সেই কক্ষে ওদের শারীরিক নিরাপত্তা কি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে পেরেছিল? দায় কি ওই বিমান চালকের নিয়তির, যিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন? এ দায় কি ওই ঘাতক বিমানের, যেটি হয়তো আগে থেকেই ছিল ত্রুটিপূর্ণ। নাকি এ দায় আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থার, যার কারণে বাহিনী বাধ্য হয়েছে এতবড় একটা ঝুঁকিপূর্ণ প্রশিক্ষণে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম নগরী ঢাকার আকাশকে বেছে নিতে। দায় যারই থাকুক, ঘুণাক্ষরেও কেউ তা নিজের ওপর কেউ নেবে না বলেই আমার ধারণা। যে যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, সঠিক তদন্তে গ্রহণযোগ্য যুক্তির মাধ্যমে নিরেট প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হলে জনতার মাঝে অসন্তোষ থাকবেই।

ঢাকার আকাশে যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের বিষয়টা শোনার শুরুতেই কেমন যেন বেমানান লেগেছিল আমার কাছে। আমি কোনো বিমান দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ নই। তবে আমার মতো হাজারো সাধারণ মানুষ আছে যারা অন্তত এটা বিশ্বাস করে যে, এ প্রশিক্ষণ কর্মযজ্ঞটা যদি জনমানবহীন এলাকা বা কোনো বিরানভূমিতে হতো, তাহলে আজ জাতিকে এ নিষ্পাপ সন্তানদের পোড়া লাশ কাঁধে নিয়ে আর্তনাদ করতে হতো না। বিশেষজ্ঞের মন্তব্য খুঁজতে গিয়ে ২৩ জুলাইয়ের প্রথম আলোর একটি লেখা চোখে পড়ল। বিশ্লেষণধর্মী এ লেখার শিরোনাম ছিল ‘এই মৃত্যু কি আমরা এড়াতে পারতাম না’। লিখেছেন সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ। বিভিন্ন বিমান দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রধান হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, যদি আমাদের যুদ্ধবিমান উড্ডয়নের জন্য কোনো স্বতন্ত্র রানওয়ে থাকত, যার অবস্থান হতো লোকালয় থেকে দূরে বিস্তীর্ণ মাঠ অথবা চর অঞ্চলে অথবা অন্য কোনো জায়গায়, তাহলে দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত। উদাহরণ হিসাবে তিনি লালমনিরহাটের পরিত্যক্ত বিমানবন্দরের কথা উল্লেখ করে সেটি চালু না থাকায় আক্ষেপ করেন। যুদ্ধবিমান চালানোর যে দীর্ঘ রানওয়ে দরকার, তা চট্টগ্রাম ও সিলেটে রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ঢাকার মতো একটি জনবহুল শহরের যেখানে এত ঘনঘন উঁচু ভবন, সেখানকার আকাশ যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের সময় দুর্ঘটনাকবলিত হলে যে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটবে তা এ বিশেষজ্ঞের বক্তব্যেই স্পষ্ট। অন্তত এটা বোঝা গেল ঢাকার আকাশে যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের পরিবেশ অনুকূল নয়। তাহলে এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাতেই কেন এ আয়োজন?

জানা যায়, চীনের তৈরি এফ-৭ বিজিআই মডেলের যে বিমানটি স্কুলে আছড়ে পড়ে সেই একই মডেলের যুদ্ধবিমানের আগেও দুবার দুর্ঘটনার শিকার হয়। ২০১৮ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুরের রসুলপুরে ফায়ারিং রেঞ্জে মহড়ার সময় বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দিপু নিহত হন। এরপর ২০২১ সালে চট্টগ্রামের জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ এমবি। এতে নিহত হন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ। উল্লিখিত দুটি দুর্ঘটনা জনবহুল এলাকায় না হওয়ায় কোনো সাধারণ মানুষ কিন্তু হতাহত হয়নি। একই মডেলের বিমান যেহেতু আগেও দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে তাহলে কোনো ভরসায় বা কোনো যুক্তিতে ঢাকার আকাশপথ এবার বেছে নেওয়া হলো?

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর দিয়ে নিয়মিত বিমান শোঁ শোঁ বিকট আওয়াজে নিয়মিত ওড়ে যায় বলে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছে । এই শোঁ শোঁ আওয়াজ ক্লাসের কোমলমতি শিশুদের জন্য নিশ্চয়ই আতঙ্কের। দুঃখজনক বিষয় হলো, শব্দ দূষণ আর আতঙ্কের বিষয় নিয়ে কথা বলার একজনও ছিল না তখন। ঘটনা যখন ঘটে, কেবল তখন অনিয়ম আর অবহেলার কথা বেরিয়ে আসে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এ দুর্ঘটনা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন কোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধীরা মিথ্যা দিয়ে অপরাধ ঢাকার জন্য আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে ওঠেপড়ে লাগে।

যদি দুর্ঘটনার পেছনে কোনো গাফিলতি বা অবহেলা থাকে তাহলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে বের হয়ে আসুক প্রকৃত তথ্য। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করলে প্রশিক্ষণ রুট ঢাকার আকাশে আর উচিত নয়। তবে যদি বাঞ্ছনীয়ই হয় তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ঘনবসতি এলাকাকে অবশ্যই ‘নো ফ্লাই জোন’-এর আওতায় এনে তারপর অন্যকিছু ভাবতে হবে। হাসপাতালে দগ্ধ শিশুর কাতরানোর গা শিউরে ওঠার হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমরা আর দেখতে চাই না। ঝলসানো শরীর ও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দুর্ঘটনাস্থল থেকে নিজ পায়ে হেঁটে বের হওয়া আর কোনো ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়ানের বিভীষিকাময় দৃশ্য চাই না আর। ‘বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত’ স্লোগানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী যে শপথ বুকে ধারণ করেছে, সে শপথের গগনে দেশের স্থলভাগ যেন সুরক্ষিত থাকে, সেদিকেও এখন সমানভাবে ভাবতে হবে তাদের।

বদরুল হুদা : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কিশোরগঞ্জ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম