Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে বন্দি রাজনীতি

Icon

মেজর (অব.) মনজুর কাদের

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে বন্দি রাজনীতি

বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী থাকা অবস্থায় (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ৩০ মার্চ ১৯৭২) সৃষ্ট হওয়া অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যার মাধ্যমে একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসন পদ্ধতি কায়েম করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।

এ স্বৈরাশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারসহ নিহত হওয়ার পর আধিপত্যবাদী শক্তি বাকশালের প্রেতাত্মাদের দ্রুত রাজনীতিতে ফেরানোর জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, যার ফলস্বরূপ একই বছরের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্ব পালটা অভ্যুত্থান ঘটে এবং সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দি হন। অভ্যুত্থানের নেতা খালেদ মোশাররফ নিজেই নিজেকে ব্রিগেডিয়ার পদ থেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন।

সিপাহি-জনতার বিপ্লব : লোকমুখে যখন জানাজানি হয়ে যায়, এ পালটা অভ্যুত্থান আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী শক্তির মদদপুষ্ট, তখন দেশপ্রেমিক শক্তি দ্রুত পালটা ব্যবস্থা নেয়, যার ফলে জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাতে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন (কার্যত/defacto কারণ আইনগত/de jure প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিচারপতি সায়েম) হন। তবে আধিপত্যবাদী শক্তি তাকে যে কোনোভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে একের পর এক ষড়যন্ত্র করতে থাকে।

রেফারেন্ডাম (হ্যাঁ/না ভোট) : প্রেসিডেন্ট সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়াউর রহমান তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তিনি ১৯৭৭ সালের ৩০ মে রেফারেন্ডামের (হ্যাঁ/না ভোট) আয়োজন করেন, যেখানে ভোটারদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, ‘আপনি কি প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম এবং তার গৃহীত নীতি ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা রাখেন’ এ গণভোটের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বিজয়ী হন।

কণ্টকাকীর্ণ পথ : কিন্তু আধিপত্যবাদী শক্তি জিয়াউর রহমানের চলার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করার জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে শ্রমিক ধর্মঘট ডাকার মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য চলাচল বন্ধ করে দিয়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হয়। টেলিফোন বিভাগের কর্মচারীদের ধর্মঘটের কারণে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। প্রতিটি সেক্টরে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে জিয়াউর রহমানকে অস্থির করে রাখা হয়।

জাপানি বিমান হাইজ্যাক : এ অস্থির পরিস্থিতিতে জাপানি রেড আর্মির বিমান হাইজ্যাক ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের একমাত্র বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা। জাপানের কমিউনিস্ট পার্টির সামরিক সংগঠন রেড আর্মির হিদাকা কমান্ডো ইউনিটের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের দল ১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্যারিস থেকে টোকিও যাওয়ার পথে জাপান এয়ারলাইন্সের (JAL) ডি-৮ বহরের একটি বিমান হাইজ্যাক করে ক্রুসহ ১৫৬ জন যাত্রী জিম্মি করে বিমানটিকে জোরপূর্বক ঢাকার পুরোনো তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করায়।

মুক্তিপণ হিসাবে তারা জাপান সরকারের কাছে ৬ মিলিয়ন ডলার ও তাদের সংগঠনের আটককৃত ৯ সদস্যদের মুক্তি দাবি করে। টানা ৪ দিন তারা হাইজ্যাক করা বিমান নিয়ে ঢাকা অবস্থান করে। সরকারের মধ্যস্থতায় জাপানের বিমানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ২ অক্টোবর দাবি মেনে নেওয়ায় হাইজ্যাক নাটকের অবসান হয়।

হাইজ্যাকের আড়ালে সেনাবিদ্রোহ : অপরদিকে হাইজ্যাকের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র। ১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী দিবসে মূল বিদ্রোহের পরিকল্পনা করা হয়। এর দুদিন পর ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়া সেনানিবাসে ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বিদ্রোহ করে। কিন্তু সেদিন তা বিচ্ছিন্ন ও ব্যর্থ হলে ইউনিটটিকে বিলুপ্ত করা হয়। যশোর সেনানিবাসে অভ্যুত্থান ঘটার আগেই তা শনাক্ত করা হয়।

এদিকে বগুড়ার ব্যর্থ অভ্যুত্থান এবং হাইজ্যাক ঘটনা শেষ হওয়ার মুহূর্তেই ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকা সেনানিবাসে শুরু হয় বিদ্রোহ। বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের সৈনিকরা বিদ্রোহ করে এবং একই সঙ্গে বিমানবাহিনীর জওয়ানরা রেডিও স্টেশন দখল করে নেয়, হামলা চালায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাসভবনে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে লাইনে দাঁড় করিয়ে বার্স্ট ফায়ারে হত্যা করে বিমানবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের। ক্রান্তিকালে জিয়ার অনুগত সৈনিকরা প্রতি-আক্রমণ করে বিমানবন্দর পুনঃদখল করে নেয়। বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট আফসার আলী খান, যিনি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। বিদ্রোহের প্রকৃত কারণ ও নেতৃত্ব আজও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তবে এ বিদ্রোহের পর জিয়াউর রহমান জাসদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেন। বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গঠিত হয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, যেখানে বিচার করা হয় বিদ্রোহীদের।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ : এ প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি) বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ তফসিলি জাতি ফেডারেশন এবং জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল)-এর সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করেন। সরাসরি ভোটে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করে। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল এমএজি ওসমানী গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের (গজ) ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিয়াউর রহমানের কাছে পরাজিত হন। এরপর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট বিলুপ্ত করে ১৯৭৮ সালে বিএনপি গঠিত হয়। ন্যাপ (ভাসানী) বিএনপির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।

আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্টরা জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত প্রায় ১৯টি সামরিক বিদ্রোহ করে এবং শেষটি ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সংঘটিত হয়, যেখানে তিনি শাহাদতবরণ করেন। জিয়াবিহীন অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করেন।

জামায়াতের সমর্থনে ১৯৯১ সালে বিএনপির সরকার গঠন : বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও বাম জোট জেনারেল এরশাদকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ১৯৯১-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আধিপত্যবাদী শক্তি নিশ্চিত ছিল, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, তা প্রমাণ করে দিয়ে নির্বাচনে বিএনপিকে বিজয়ী করার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামী সমর্থন দিলে বিএনপি সরকার গঠন করে। এরপর থেকে পতিত আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করতে থাকে আধিপত্যবাদী শক্তি।

চারদলীয় জোট-আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তবে জাতীয় পার্টি চারদলীয় জোটে যোগদান করায় বিপদে পড়ে যায় এ অপশক্তি। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি (পরবর্তীকালে জাপার একাংশ) নিয়ে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এ জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন লাভ করে।

৯/১১-এর ঘটনা সবকিছু বদলে দেয় : তবে ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর (৯/১১) যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার এবং সামরিক হেডকোয়ার্টার্স পেন্টাগনে হামলা হলে এবং বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে গেলে মুসলিম দেশগুলোকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। এ সুযোগে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে এবং চারদলীয় জোটের শাসনামলে একই সময়ে দেশের ৬৩টি জেলা সদরে জেএমবির বোমা হামলা, যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়। এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে সরকার ব্যর্থ হয়, তার ওপর ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ কয়েকজন নেতার নিহত হওয়ার ঘটনা ও শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা করে এসব সন্ত্রাসী ঘটনার দায়ভার চারদলীয় জোট সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলতে থাকে যে, মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী অপশক্তির তথা স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্রের কারণে দেশের মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্ট আওয়ামী লীগের এ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকার পশ্চিমা বিশ্বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো সক্রিয় যোগাযোগ না রাখার কারণে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ হস্তক্ষেপ করে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং সরকার চারদলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করে নাস্তানাবুদ করে দেয়।

২০০৮ সালের নির্বাচন-আধিপত্যবাদী শক্তির তাঁবেদারের পুনরুত্থান : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রথমে ১৪ দলীয় ঐক্যজোট এবং পরবর্তী সময়ে অন্যান্য বিরোধী দলের যোগদানের ফলে মহাজোট গঠিত হয় এবং ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তথা মহাবিজয় অর্জন করে। এরপর ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির সরাসরি মদদপুষ্ট হয়ে শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্টে রূপান্তরিত হন।

ফ্যাসিস্টের অত্যাচার-নির্যাতন : ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির মদদে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে গঠিত সরকারের আমল থেকে শুরু করে ফ্যাসিস্ট হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামি দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে হত্যা, গুম, খুন, জখম, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে এবং তাদের ব্যবসা, বাণিজ্য, পারিবারিক জীবন, চাকরি-বাকরি তছনছ করে দিয়েছে।

নতুন স্নায়ুযুদ্ধ : এ অবস্থায় ২০১৭ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মোকাবিলা করার জন্য পররাষ্ট্রনীতিকে পুরোনো ধারায় ফিরিয়ে নেয়, যা ছিল ইসলামি দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রেখে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটানো। এখন কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং চীনের বন্ধু রাশিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য আমেরিকার প্রয়োজন মুসলিম দেশগুলো। এ কারণে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তালেবানদের সঙ্গে চুক্তি করে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ভারতের অগোচরেই বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ঘটে এবং ভারত এ ফ্যাসিস্টকে আশ্রয় দিলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শত্রুতে পরিণত হয় দেশটি। আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার পর ভারত দিশেহারা হয়ে পড়ে।

শুরু হয়েছে ষড়যন্ত্র : বাংলাদেশের আকাশে আবার ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা শুরু হয়েছে, যেমনটি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে হয়েছিল। ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছে অনেকে, আহত ও দগ্ধ হয়েছে শতাধিক, যাদের বেশির ভাগই শিশু শিক্ষার্থী।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক বিক্ষোভের আয়োজন করা হয় পরদিন, সচিবালয় দখল করে গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনা ঘটল দিয়াবাড়িতে আর আন্দোলন হলো সচিবালয়ে। এ যেন অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর ডায়ালগের মতো: ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’।

১৯৭৭ সালেও এরকমটি হয়েছিল। জাপান এয়ার লাইন্সের বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকা অবস্থায় ষড়যন্ত্রকারীরা সামরিক ক্যু করে ক্ষমতায় গিয়ে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিধন করতে চেয়েছিল।

দীর্ঘ ৪৮ বছর পর পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। একই ধরনের distraction অর্থাৎ সবার মনোযোগকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়া। দেশপ্রেমিকরা তাই আগের মতো জেগে উঠেছেন। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের চিন্তাধারা সমুন্নত রাখার জন্য সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আলোচনা করেছেন, বুঝিয়েছেন আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, যেমনভাবে মালদ্বীপের মতো ছোট দেশ নির্বাচনি যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল।

২৫ জুলাই নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চারটি দলের শীর্ষনেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমাদ আবদুল কাদের, নেজামে ইসলাম পার্টির সহসভাপতি মাওলানা আবদুল মাজেদ আতহারী, দলটির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন।

ফ্যাসিস্টের বিচার ও মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐক্য প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন দলগুলোর শীর্ষনেতারা। এ দলগুলোর সঙ্গে অন্যান্য দেশপ্রেমিক দল মিলে নির্বাচনি ফ্রন্ট করলে পরিস্থিতি পালটে যেতে পারে।

ইসলামি দলগুলোর ওপর পশ্চিমা বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের চাপ নেই : ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার মাটিতে সন্ত্রাসী হামলার কারণে ইসলামি দলগুলোর ওপর জঙ্গিবাদের যে তকমা লাগানো হয়েছিল, এখন আর তা নেই। সময়ের ব্যবধানে এবং বিশ্বরাজনীতি বদলে যাওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও সুসংহত করার বিরাট সুযোগ এসেছে। ১৯৭৯, ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামি শক্তি একত্রে যেভাবে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য নির্বাচনি সমঝোতা গড়েছিল, ঠিক একই কায়দায় আগামী সংসদ নির্বাচনে কৌশলগত অবস্থান নিয়ে দলগুলো আধিপত্যবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

মেজর (অব.) মনজুর কাদের : সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ-সদস্য

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম