বিরাজনীতিকরণের ভূত যেন ফের চেপে না বসে
আবু রূশদ
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘মানুষ একটি রাজনৈতিক প্রাণি’-অ্যারিস্টোটল
আব্দুল আহাদ-মাত্র চার বছরের এক শিশু। তার বাবা-মার সঙ্গে থাকত ঢাকার রায়েরবাগে। গত বছর ১৯ জুলাই সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়। রিয়া গোপ নামের ছয় বছরের আরেক শিশু ঢাকায় নিহত হয় ছাদে খেলা করার সময়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে তৎকালীন সরকারের লেলিয়ে দেওয়া কিলিং স্কোয়াড তাকে হত্যা করে।
চার থেকে সতেরো বছরের অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোরদের অন্তত ৬৬ জনের তালিকা নিশ্চিত করা যায় পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের উদ্ঘাটিত তথ্যানুযায়ী আন্দোলনে নিহত প্রায় এক হাজার চারশর মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হলো শিশু-কিশোর। অন্য কয়েকটি সূত্রমতে ১৮ বছরের নিচে নিহতের সংখ্যা হবে ১৮০ জনের মতো।
আহাদের মতো একজন অবলা শিশু কি জানত তার কী অপরাধ? একটা রাষ্ট্র একুশ শতকের পৃথিবীতে কেন তার মতো একটি শিশুকে গুলি করে হত্যা করল? কেন রিয়া গোপের প্রাণ কেড়ে নিতে হলো একটি রাষ্ট্রকে, যে কিনা জানতই না রাষ্ট্র কী। যারা এ শিশুদের হত্যা করেছে, তারা কি দেখেনি ওরা শিশু? গুলি করার সময় ওদের হাত কি একটুও কাঁপেনি? শুধু নিজ পছন্দের একটি অনির্বাচিত সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য, সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য ছোট্ট শিশুদের হত্যা করে বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যদের বিবেক মোটেও নিজ বিবেকের কাছে প্রশ্ন করেনি।
কেন এমন ভয়াবহ স্যাডিস্ট মানসিকতার জন্ম হয়েছিল দেশের প্রতিটি বাহিনীর মধ্যে? প্রশাসনের মধ্যে? সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়াই হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজমের শিকড় অনুসন্ধানের প্রকরণ।
এদিকে, সম্প্রতি বিবিসি গত ৮ জুলাই তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া অডিও থেকে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী গত বছর আন্দোলনকারীদের ভয়াবহ কায়দায় দমনের নির্দেশ দেন। এখন বিশ্ব জানে তরুণ-যুবকদের সংগঠিত ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে কীভাবে জনতা যোগদান করেছিল আর কত নিরীহ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এমনকি র্যাবের মতো বাহিনী তাদের হেলিকপ্টার দিয়ে রাত দিন স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে, গুলি করে মানুষ ও শিশুদের হত্যা করেছে। স্নাইপার রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষিত স্নাইপাররা বিভিন্ন ভবনে অবস্থান নিয়ে টার্গেট করে করে তরুণ-তরুণীদের হত্যা করেছে। ভাবা যায়?
ওই স্নাইপাররা ছিল তদানীন্তন সরকারের গুণমুগ্ধ ক্যাডারবিশেষ। তারা দেখল, যদি আওয়ামী লীগ সরকার না থাকে, তাহলে তারা অন্যায়ভাবে যেসব সুবিধাদি নিয়ে থাকে, সেসব আর থাকবে না। তাই নিজ জাতির বিরুদ্ধেই তারা দাঁড়িয়ে গেল। গুলি করে হত্যা করল শিশু, কিশোর, যুবক-যুবতীদের। এটাই ঘটেছিল তখন বাংলাদেশে। এ যেন ছিল কুখ্যাত রোমান সাম্রাজ্যের শাসক ক্যালিগুলা বা মঙ্গোল হালাকু খানের শাসনের মতো এক অবিশ্বাস্য ক্রূরতায় ভরা মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতে পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নয়, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-সরকারি প্রশাসন-সশস্ত্র বাহিনীসহ সব ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের নামে এক রামরাজত্ব ও বিভীষিকাময় পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। প্রায় এক কোটি রাজনৈতিক নেতাকর্মীর নামে মামলার পর মামলা দেওয়া হয়েছে। সে সময় হাজার হাজার মানুষকে কিডন্যাপ করা হয় গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। অসংখ্য মানুষকে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়। জঙ্গি তকমা দিয়ে যাকে-তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, নিরেট রাজনৈতিক কর্মীকে ভয়াবহ জঙ্গির তালিকায় ফেলা হয়।
নিজের কথাই বলি। ১৯৯০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর আমি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নিই। কয়েকটি শীর্ষ দৈনিকে বিভিন্ন পদে কাজ করেছি। মাঠেঘাটে থেকে সাড়া জাগানো সব রিপোর্ট করেছি। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত একটি সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে, যাকে ওয়ান-ইলেভেন বলা হয়, আমাকে বাধ্য হয়ে দৈনিক পত্রিকা ছেড়ে আসতে হয়। তখনই আসলে শুরু হয় নিবর্তনবাদের যাত্রা। এরই বিষময় ফল হলো পনেরো বছরের জন্য আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতিহীন বিভীষিকাময় দুঃসহ শাসন জাতির ঘাড়ে চেপে বসা।
অথচ, ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র ফিরে এলে বাংলাদেশ শত সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হানাহানি সত্ত্বেও একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে থাকে। তখন সাংবাদিকরা মন খুলে রিপোর্ট করতে পারত, দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে কলম চালাতে পারত। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক খাতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়া শুরু করেছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-পাকিস্তানের আগেই মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করার ফলে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন যুগে প্রবেশ করে দেশ। অনেকেই হয়তো জানে না, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম ১৯৯৪ সালে মোবাইল ফোনের যাত্রা শুরু হয়। নারী শিক্ষা, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, শিশু-নারী মৃত্যুহার হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, স্যানিটেশন খাতে তরতর করে এগিয়ে যায় দেশ।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন, গোলাম আযমের নাগরিকত্ব নিয়ে হট্টগোল, যুব কমান্ড নামে পালটা প্ল্যাটফর্ম দাঁড়িয়ে যাওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের নজিরবিহীন ঐক্যকে ছাপিয়েও বাংলাদেশ ঠিকই একটি বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসনের পথেই এগিয়ে চলছিল। যেসব দেশে গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তির ওপর আজ দাঁড়িয়ে আছে, তাদেরও চলার পথের শুরুতে বহু চড়াই-উতরাই অতিক্রম করতে হয়েছে। একটি ব্যবস্থা লাইনে উঠতে সময় লাগে। বাংলাদেশ সেটা পায়নি, হতে দেওয়া হয়নি।
এটা রূঢ় বাস্তবতা যে, ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোটের সরকার ক্ষমতায় আসার ঠিক আগ দিয়ে ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে নাইন-ইলেভেনের মতো ভয়ংকর সন্ত্রাসী ঘটনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশও ব্র্যাকেটবন্দি হয় কৌশলগত কারণে। দশ ট্রাক অস্ত্র আটকসহ ৬৩টি জেলায় একযোগে জেএমবির বোমা বিস্ফোরণ, সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ, বিরোধিদলীয় নেত্রীর সমাবেশে গ্রেনেড হামলা অনেক হিসাব-নিকাশ পালটে দেয়। চারদলীয় জোটের অংশীদার ধর্মভিত্তিক একটি দল প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করে-‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। এ একটি ইস্যুকে দেশের একশ্রেণির বিরাজনীতিকরণবিদ ব্যবহার করে সুযোগ হিসাবে। এটি ছিল চরম দায়িতজ্ঞানহীন এক স্লোগান, বাস্তবতার বাইরে গিয়ে দেশকে ফাঁদে ফেলার চরম বোকামি। দশ ট্রাক অস্ত্র পাচারের উদ্যোগ তাতে আগুনে ঘি ঢালে। এ ঘটনা ভারতকে সুযোগ করে দেয় বিশ্বকে বোঝাতে যে, বাংলাদেশের তদানীন্তন সরকার তাদের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। তারপরও বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার সহনশীলতার মধ্যে তা মোকাবিলার চেষ্টা করছিল।
কিন্তু অভ্যন্তরীণ সুযোগসন্ধানীদের পাশাপাশি তদানীন্তন মার্কিন, ব্রিটিশ ও ভারত প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কথিত সৎ লোকের শাসন কায়েম, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনের নামে ওয়ান-ইলেভেন হয়। এমন একটি ধারণা প্রচার করা হয় যে, রাজনীতি মানেই বর্জনীয় বিষয়। বিরাজনীতিকরণই হলো মোক্ষ লাভের একমাত্র উপায়। সিপিডি, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনসহ কয়েকটি সংগঠন উঠেপড়ে লাগে দেশকে রাজনীতিশূন্য করতে। পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি দেখভাল করার দায়িত্ব অনেকটাই দিয়ে দেওয়া হয় আঞ্চলিক শক্তি ভারতের হাতে। সেই থেকে শুরু। মার্কিন ওবামা প্রশাসন এ দায় এড়াতে পারে না।
এদিকে আমি ২০০৮ সাল থেকে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি প্রতিরক্ষা জার্নাল প্রতিষ্ঠিত করি বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল নামে। যেহেতু আমার হাত দিয়ে নব্বই দশকে বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু হয়, তাই আমি পেশাদার সাংবাদিক হিসাবে এ বিষয়টিকেই বাংলাদেশে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু যেহেতু আমি ছিলাম প্রতিবাদী, আধিপত্যবাদী শক্তির সীমাহীন রূঢ় আচরণের বিরোধী তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পর গোয়েন্দা সংস্থা আমাকে ঘিরে ধরে। ২০১৫ সালে সরকারবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ দিয়ে দেশের সব সেনানিবাসে আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে সেনা সদরদপ্তর। সে সময় সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। তিনি দায় নিতে চাননি। দায় চাপিয়ে দেন ডিজিএফআইয়ের দিকে। আমার মতো অনেক অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারই অবাঞ্ছিত ঘোষিত হয়েছেন তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ায়, এমনকি শুধু বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার ‘অপরাধে’। বহু প্রতিভাবান সেনা কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেক যোগ্য পুলিশ অফিসারকে বাড়ি চলে যেতে হয়েছে। যার সেক্রেটারি হওয়ার কথা তিনি ডেপুটি সেক্রেটারি পদেই অবসরে গেছেন।
যা হোক, অবাঞ্ছিত হওয়ায় সেনা হাসপাতালে আমার চিকিৎসা সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থা আমার জার্নালকে ঘিরে ধরে। যেসব প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন প্রদান করত তাদের কড়া ভাষায় বলে দেওয়া হয়, যাতে আর কোনো বিজ্ঞাপন না দেয়। ডিজিএফআই থেকে সরাসরি হুমকি দিয়ে বলা হয়, আমার কি পরিবার নেই? আমি আমার পিতার রেখে যাওয়া অল্প বিস্তর সম্পত্তি খুবই অল্প দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হই আমার জার্নালটিকে চালিয়ে রাখার জন্য। এখনো প্রায় ছিন্নভিন্ন অবস্থায় আছি। এমন সাংবাদিকের সংখ্যা অগণিত, যারা সব খুইয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের রোষের মুখে পড়ে।
এমনকি সৌদি বাদশাহর আমন্ত্রিত হয়ে পবিত্র হজে যাওয়ার সময় ডিজিএফআই আমাকে বিমান থেকে অফলোড করে ২০১৫ সালের ২০ মে। এরপর দীর্ঘদিন আমি বিদেশে যেতে পারিনি। নিজের কথা বললাম এই কারণে যে, মোটামুটি যারা দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছে, বাংলাদেশে হয়তো তাদেরই একজন ছিলাম আমি। আমারই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে সাধারণ সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মীদের কী অবস্থা হয়েছিল?
এসব কি রাজনীতির জন্য হয়েছে? নাকি রাজনীতি না করে ডাণ্ডাতন্ত্র কায়েমের জন্য হয়েছে? গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে দেশ চালানোর জন্য হয়েছে?
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর আজ অবধি দেশে অনেক অস্থিরতা চলছে। প্রশাসন, পুলিশ ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না বা করছে না। একটি দীর্ঘ নিবর্তনবাদী শাসনের পর এমন অবস্থা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অবস্থা আরও ভালো হওয়ার কথা ছিল। সবচেয়ে যে বিষয়টি এখন আমাদের ভাবিয়ে তুলছে তা হচ্ছে, আবারও সেই বিরাজনীতিকরণের সুর কয়েকটি চিহ্নিত জায়গা থেকে উচ্চারিত হওয়া। অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষ, সাবেক সরকারি আমলাদের একটি অংশ যারা অভ্যুত্থানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন তারাও নির্বাচন ছাড়া, রাজনীতি ছাড়া দেশ পরিচালনার অদ্ভুত দাবি তুলছেন। ওয়ান-ইলেভেনের পরিচিত মুখগুলো ও তাদের লালনকারী একটি তথাকথিত সুশীল গোষ্ঠী রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে সেই পুরোনো খায়েশ বাস্তবায়নের জন্য। সেই একই কথা প্রচার করা হচ্ছে-রাজনীতি হলো খারাপ জিনিস। তাই রাজনীতি ছাড়া চলবে দেশ।
বলি কতিপয় রাজনৈতিক কর্মীর চাঁদাবাজি, দখলবাজির জন্য যদি রাজনীতি উঠিয়ে দেওয়ার আবদার করা হয়, তাহলে কি সীমাহীন মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই উঠিয়ে দিতে হবে? না। কয়েকজনের জন্য পুরো প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থাপনাকে আমরা দায়ী করতে পারি না।
শেখ হাসিনার অপশাসন বা তার আগে ওয়ান-ইলেভেন যে জটিলতার সৃষ্টি করেছে তার জন্য রাজনীতি দায়ী নয়। আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতি না করে বিরাজনীতিকরণের ভূতকে লালনপালন করেছে। দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি বলে, তাদের পছন্দনীয় রাজনীতিবিদদের নির্বাচিত করতে পারেনি বলেই ২০২৪ সালে এত ক্ষোভ দেখা গেছে। শুধু সীমাহীন দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা নয়, রাজনৈতিক অধিকার হরণ করার বিরুদ্ধেই সব পেশা শ্রেণির মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, আওয়ামী আদর্শ ও শাসনের প্রতিটি প্রতীকী উপস্থিতিকে ভেঙে চুরমার করেছিল। যদি হাসিনা নির্বাচন দিতেন ঠিকমতো, তাহলে হয়তো এত ক্ষোভের মুখে তাকে পড়তে হতো না, দেশ থেকে পালাতে হতো না।
দেশ রাজনীতি দিয়েই চালাতে হবে। কোনো অনির্বাচিত সরকার, টেকনোক্র্যাট, সুশীল শ্রেণি বেশি দিন একটি রাষ্ট্রের হাল ধরে থাকতে পারে না। এটা আবারও বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসবে, যা হবে অকল্পনীয়।
চাঁদাবাজি, দখলবাজি, বিভিন্ন পদ দখল নিয়ে কথা উঠেছে। তবে এটাও তো সত্য যে, আগে এসব নিয়ে কোনো কথা বলতে সাহস পেত না মানুষ। কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হতো না। হেলমেট বাহিনীকে উলটো প্রশ্রয় দেওয়া হতো সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। আজ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব যতটুকু পারেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন। দীর্ঘদিনের অপশাসনে যে বিভিন্ন স্তরে পচন ধরেছে, তা এক বছর, দুবছরে যাবে না। তবে আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক কৌশলগত পরিস্থিতি, কূটনীতিসহ ব্যবসা-বিনিয়োগ বুঝে দেশ চালাতে হলে রাজনীতি লাগবে। গণতন্ত্র লাগবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তারপরও ঝামেলা থাকবে। তাও মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। কোথায় ঝামেলা নেই? আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান, ভারত-কোথায় নেই ঝামেলা? আছে, থাকবে। কিন্তু বিরাজনীতিকরণের মতো দেশ ধ্বংসকারী আর কিছুই হতে পারে না। জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের রাজনীতিকে সুষ্ঠু ধারায় ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছে, কথা বলার সুযোগ দিয়েছে। এ সুযোগকে অপব্যবহার না করে কাজে লাগানোই হতে পারে একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ গড়ার কার্যকর উপায়। ভুলে গেলে চলবে না অ্যারিস্টোটল বলেছেন-‘মানুষ একটি রাজনৈতিক প্রাণী।’
আবু রূশদ : সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাংবাদিক-বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক
