আগস্ট অভ্যুত্থানের এক বছর : বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে
অনিকেত চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এক বছর হতে চলল বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের। কেউ এ অভ্যুত্থানটাকে বলছেন মেটিকুলাসলি প্ল্যান্ড, কেউ বলছেন, এটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আসলে কোনো কারণ ছাড়াই গোটা দেশের মানুষ এ অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছেন, এমন নয়। আর মানুষের সমর্থন ছাড়া শুধু ছাত্ররা একটা অভ্যুত্থান করে দেবেন, তাও সম্ভব নয়। অগণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং লাগাম ছাড়া দুর্নীতির কারণে মানুষের মনে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভেরই প্রতিফল ছিল এ অভ্যুত্থান। বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য তো শুধু একজন শাসক একটা দলের পরিবর্তন ছিল না। লক্ষ্য ছিল পুরো ব্যবস্থার বদল। এক বছর পর বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করতে গেলে দেখা যাচ্ছে, দেশটি এক সংকট থেকে বেরিয়ে আরও জটিল সংকটের চক্রে আটকে যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। নির্বাচন কমিশন কাজও শুরু করেছে; কিন্তু নির্বাচনের পথ তৈরি করার যে প্রক্রিয়া, তা নিজেই নতুন রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে দুটো দলিল। একটা হচ্ছে জুলাই ঘোষণাপত্র, অপরটি জুলাই জাতীয় সনদ। যে দলিলগুলো ঐক্যের প্রতীক হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো এখন বিভেদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, এ ঘোষণাপত্র যদি ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তারা এর বিরোধিতা করবে। আবার যে ছাত্র সংগঠনগুলো বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল, যেমন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), তারা মনে করে এ ঘোষণাপত্র ছাড়া ফ্যাসিবাদকে স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত করা সম্ভব নয়। এ বিভেদ
এতটা গভীর যে, এনসিপি নেতা হান্নান মাসুদ জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন।
দ্বিতীয় দাবিটা ছিল মানবাধিকার ও বিচার। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা ভীষণ স্ববিরোধী। একটা প্যারাডক্সিকাল। বর্তমান সময়ে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। সেন্ট্রালাইজ্ড বা কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের জায়গা নিয়েছে ডিসেন্ট্রালাইজ্ড বা বিকেন্দ্রীভূত সহিংসতা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বলছে, আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫-এর মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতের ৪৭১টি ঘটনায় ১২১ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন ৫ হাজার ১৮৯ জন। মব কিলিং মানে গণপিটুনিতে মারা গেছেন ১৭৯ জন। ভাবা যায়? এ সময়ের মধ্যে ৮৭৮ সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন, যা আগের তুলনায় ২৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে কীসের অভ্যুত্থান ছিল এটা? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সহিংস লড়াই শুরু হয়েছে। দুর্নীতির তদন্ত করার পাশাপাশি বর্তমানে সাধারণ আইনশৃঙ্খলার অভাব একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশকিছু শিল্পপতি দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। অতএব, অনেক কারখানা বন্ধ, অনেক ইনভেস্টমেন্ট বন্ধ, তারা টাকাপয়সা ফ্রিজ করে অন্যান্য জায়গায়, যেভাবে হোক নিয়ে অন্য দেশে পালিয়েছে। এটা একটা বড় কারণ। এ ছাড়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগে ভাটা এবং বিশ্ব অর্থনীতির চাপ-সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বসে থাকলেও অর্থনীতির প্রায় পুরো সূচক নিুগামী। মুদ্রাস্ফীতি ভীষণভাবে বাড়ছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে এবং তার ওপর এ পরিস্থিতি একটা দুষ্টচক্র তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক কষ্টের কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে-যা রাজনৈতিক সংঘাত, সামাজিক অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তাহলে বিপ্লব কি পথ হারাচ্ছে? যে ছাত্র-আন্দোলন অবিশ্বাস্য একতার নিদর্শন দেখিয়েছিল, এক বছরের মাথায় সেই আন্দোলন বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। আটলান্টিক কাউন্সিলের এক বিশ্লেষণ বলছে, বিপ্লবের আদত মূলধন পকেটমার হয়ে গেছে এবং বিপ্লবের মূলশক্তি বিভিন্ন দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে হারিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, এক বছর পর বাংলাদেশ এক বিপজ্জনক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক গণতান্ত্রিক ন্যায়ভিত্তিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা আজ অর্থনৈতিক পতন, আইনশৃঙ্খলার বিপর্যয়, খণ্ডিত রাজনৈতিক বাস্তবতার নিচে চাপা পড়েছে। এক কথায়, বাংলাদেশ কেন্দ্রীভূত স্বৈরতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এক বিকেন্দ্রীভূত নৈরাজ্যের মধ্যে গিয়ে পড়েছে।
প্রতিশ্রুতিগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, গণতন্ত্রের স্বপ্ন সাংবিধানিক বিতর্কে আটকে গেছে। মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি নতুন ধরনের সহিংসতায় হারিয়ে গেছে। আর দুর্নীতি দমনের চেষ্টা নিরাপত্তার অভাবে হোঁচট খাচ্ছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট একে অপরকে আরও ঘনীভূত করছে, যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পাওয়া ভীষণ কঠিন। অনেক সাধারণ মানুষ এবং আন্দোলনকারী, যারা পরিবর্তনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, তারা আজ হতাশ। তাদের মনে হচ্ছে, বিপ্লবকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই এ অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ হলো, দ্রুত বিশ্বাসযোগ্য এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটা নির্বাচন আয়োজন করা। এক নির্বাচিত সরকারই শুধু জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে এবং দেশকে খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে এনে আবার পুরোনো বাংলাদেশ নতুন করে গড়ে তুলতে পারে। আগামী কয়েক মাস বিশেষ করে নির্বাচনসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো নির্ধারণ করে দেবে জাতি হিসাবে বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটবে। আমরা তাকিয়ে দেখব, তাকিয়ে থাকব।
বাংলাবাজার ইউটিউব চ্যানেলের সৌজন্যে
অনিকেত চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার
