Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি : দরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য

Icon

শিবলী আজাদ

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি : দরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য

বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি সম্পর্কিত আলোচনা জনপরিসরে নেই বললেই চলে। আলোচনার ঐতিহ্যও কখনো গড়ে ওঠেনি। অথচ, জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নটি আধুনিক রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র কল্পনাও অসম্ভব। অপরিণত ও অপূর্ণাঙ্গ হলেও স্বাধীনতার অব্যবহিত পর হামাগুড়ি দশা থেকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতি গড়ে ওঠে। বাজেটের সীমাবদ্ধতা ও ভূরাজনৈতিক হিসাবে কাম্য নীতি বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিগত সতের বছর, স্বাধীন প্রতিরক্ষা নীতির বড় অন্তরায় ছিল ফ্যাসিবাদী শাসন। পার্শ্বদেশের প্রতিরক্ষা নীতির অধীনস্থ করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় নীতি। করদরাজ্যে রূপান্তরের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেটে চলে কাটছাঁট, সীমিত করা হয় সমরাস্ত্র সংগ্রহ। অবশেষে আসে ৫ আগস্ট জাতীয় মুক্তির দিন। যুগসন্ধিকালে এসেছে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির ওপর খোলামেলা আলোচনার, জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি ঢেলে সাজানোর।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ ২.০ শুরুর স্টার্টিং পয়েন্ট। আমজনতার এ অভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডার পুরো জাতি। প্রতিরক্ষা নীতির প্রশ্নে সব স্টেকহোল্ডারের ঐকমত্যে পৌঁছানো তাই ভীষণ জরুরি। আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের আলোকে প্রতিরক্ষা নীতির বাস্তবায়নে সক্রিয়তা এখন সময়ের দাবি। রাজনৈতিক দলগুলোর অনুধাবন করা দরকার, সরকার আসবে, সরকার যাবে, কিন্তু প্রতিরক্ষা নীতির ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। উন্নত দেশগুলোয় সেটাই হয়, পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানেও তাই হয়, বাংলাদেশে তার ব্যত্যয় হতে পারে না।

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান তিন দল বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির উচিত ত্রিপক্ষীয় আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া; ডায়ালগের ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসা; জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছানো। দল তিনটিকে বুঝতে হবে, যতই চেষ্টা-তদবির করুক, পাশের দেশের মন তারা পাবে না। বাংলাদেশের প্রশ্নে দিল্লি ভীষণ একচোখা। আওয়ামী লীগের সঙ্গেই তার রাজনৈতিক প্রেম। রাজনৈতিক পরকীয়ায় জড়াতেও দিল্লি ভীষণ অনাগ্রহী। পাঁচ দশকে দিল্লি বারবার সেটা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশপন্থি কোনো দলের পক্ষে ভারতের আশীর্বাদ পাওয়া অসম্ভব।

উলটো, দিন যত যাবে, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের পক্ষে কাজ করবে সাউথ ব্লক। নির্বাচিত সরকারের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ বাড়াবে। নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার শর্ত হিসাবে ঢাকার স্বাধীন প্রতিরক্ষা নীতি থেকে সরে আসার প্রলোভন ও চাপ অব্যাহত রাখবে। দিল্লি চাইবে না, ঢাকা অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ করুক। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতি সে বাস্তবতার আলোকেই সাজাতে হবে।

বাংলাদেশের তিন বাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডারই অনাধুনিক। চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহের আশা তো দুঃস্বপ্ন। কোনো বাহিনীর হাতেই পর্যাপ্ত অস্ত্র নেই। তবে সবচেয়ে দুরবস্থায় অবশ্য বিমানবাহিনী। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার বিমানবাহিনীকে শক্তিশালী করা। বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চল এখনো রাডার পর্যবেক্ষণের আওতাধীন নয়। উত্তরবঙ্গের আকাশ একেবারেই অরক্ষিত। অথচ, ভারতের চিকেন নেক আগামী দিনের উদীয়মান ফ্ল্যাশ পয়েন্ট। ভারত-চীন সংঘর্ষের সম্ভাব্য কারণ। বাংলাদেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক। রাডার ছাড়াও বিমানবাহিনীর রয়েছে আধুনিক যুদ্ধবিমানের সংকট। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা ও বৃহৎ প্রতিবেশীর কূটনৈতিক চাপ এর মূল কারণ।

বাংলাদেশের দরকার অতি দ্রুত সময়ে তিন স্কোয়াড্রন আধুনিক জঙ্গিবিমান ক্রয়। কিন্তু ঢাকার বাজেট যেমন সীমিত, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনুকূলে নয়। প্রথমত, ঢাকার পক্ষে মার্কিনি বা ইউরোপীয় যুদ্ধবিমান কেনা অসম্ভব। ঢাকার আর্থিক ও কূটনৈতিক শক্তি নেই। মার্কিনি বিমান ক্রয়ে আবার কংগ্রেসের অনুমোদন লাগে। সে এক দীর্ঘ ও সময়সাধ্য প্রক্রিয়া। মার্কিনি কংগ্রেসে আবার দুই বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও ইসরাইলি লবির প্রভাব প্রচণ্ড। বাংলাদেশের পক্ষে অনুমোদন না পাওয়ার আশঙ্কা শতভাগ। মার্কিনি যুদ্ধবিমান আবার বিক্রয় হয় শর্তসাপেক্ষে। যুদ্ধের ময়দানেও মার্কিনি অস্ত্র ব্যবহারে অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকে। অন্য দেশের কাছে মার্কিনি প্রযুক্তি হস্তান্তর করা নিষিদ্ধ। আমেরিকার বন্ধুরাষ্ট্রের বিপক্ষে মার্কিনি অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি নেই। যুদ্ধের সময়েও ব্যবহার নিষিদ্ধ।

মার্কিনি নিষেধাজ্ঞার এমনতর বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। পাকিস্তানের ক্রয়কৃত মার্কিনি বিমানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আছে। ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধকালীনও পাকিস্তান এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ব্যবহারে অপারগ। বিক্রয়কালীন মার্কিনি শর্ত এর কারণ। আর আছে সেনসর ও কিল সুইচ-এর ভয়। ক্রেতা রাষ্ট্রের অগোচরে যুদ্ধবিমানে ডেটা কালেক্টিং সেনসর ও কিল সুইচ সফটওয়ার ইনস্টলের আশঙ্কা রয়েছে। সেনসরের মাধ্যমে ক্রেতা রাষ্ট্রের হাতে যুদ্ধবিমানের ব্যবহার, এরিয়াল ম্যানুভার ও বিমানের উড্ডয়নসংক্রান্ত গতিবিধির তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আর ক্রিটিক্যাল মুহূর্তে, দরকারে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিল সুইচ সফটওয়ার অ্যাক্টিভিশনের মাধ্যমে বিমানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়। সোজা কথায়, বিমান নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ইউরোপে প্রস্তুত করা বিমানের ক্ষেত্রেও উপরিউক্ত সমস্যা বিদ্যমান। বিক্রেতার তরফে ক্রেতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও যুদ্ধকৌশল ফাঁস-এমনকি, শত্রুপক্ষের সঙ্গে তথ্য শেয়ারের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর পশ্চিমা দেশের কাছে ঢাকা অপেক্ষা দিল্লি যে গুরুত্বপূর্ণ, বলার অপেক্ষা রাখে না।

অর্থ, প্রযুক্তি ও সামরিক নিরাপত্তার প্রশ্নে চীন, পাকিস্তান ও তুরস্কের যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের জন্য সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। মূল্য ও বিক্রয়ে আগ্রহের বিচারেও এ মুহূর্তে ঢাকার ভরসা চীন ও পাকিস্তান। চীন অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। কিন্তু চৈনিক অস্ত্রের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের আপত্তি স্পষ্ট। চীনা যুদ্ধবিমান কিনলে রোষানলে পড়তে হতে পারে। পাকিস্তানও টুকটাক অস্ত্র সরবরাহ করে। উভয় রাষ্ট্রের অভিন্ন শত্রু ভারত। চীন ও পাকিস্তান যেভাবে বাংলাদেশকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং বিপদে-আপদে দ্রুত খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করবে, অন্য দেশ করবে না। বিশেষ করে, পাকিস্তানের কথা বলা যায়। নিজের গরজেই পাকিস্তান সর্বাত্মক সাহায্য করবে। এদিকে তুরস্ক সবে যুদ্ধবিমান নির্মাণ শুরু করেছে। তবে তুর্কি বিমান এখনো ব্যাটেল প্রুভেন নয়। বিক্রির লক্ষ্যে উৎপাদনও এখনো শুরু করেনি। বাজারে আসতে কমপক্ষে আরও সাত-আট বছর বাকি।

রইল শুধু পাকিস্তান। দিল্লি ইতোমধ্যে ঢাকার পাকিস্তানি বিমান ক্রয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এ মুহূর্তে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক খারাপ। কিন্তু অচিরেই ভালো হতে পারে। হারানো প্রতাপ ফিরে পেয়ে ভারত ফের প্রভাব খাটাবে। ওয়াশিংটনের ভারত লবি ব্যবহার করে ঢাকার ওপর চাপ দেবে। সেটাই স্বাভাবিক। হাসিনার আমলে ঢাকাকে আটটি রাফায়েল বিক্রয়ের ব্যাপারে ফ্রান্স রাজি হয়। ভারতের চাপে ফ্রান্স পরে পিছিয়ে আসে। ওয়াশিংটনের চাপ বিএনপি সরকারের পক্ষে মোকাবিলা করা অসম্ভব। ভারতীয় চাপ সামলাতেই নাভিশ্বাস ওঠে।

মাঝখানে বিমান কেনাটাই ঝুলে যাবে। এদিকে, বিমানবাহিনীর বিমানগুলো অনেক পশ্চাৎপদ। বাংলাদেশের এখনই দরকার তিন স্কোয়াড্রন পাকিস্তানি জেএফ-১৭ (আপাতত ৩২টি হলেও চলবে), এক স্কোয়াড্রন চীনা জে-১০সি বিমান এবং এক স্কোয়াড্রন ডেডিকেটেড এটাক হেলিকপ্টার। কূটনীতির খেলায় সুযোগের সদ্ব্যবহারে ঢাকাকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ঢাকার সামনে মোক্ষম সুযোগ এসেছে। কারণ, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খারাপ, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে দারুণ উষ্ণ। ঢাকার পক্ষে দারুণ অনুকূল। পরিস্থিতি পরিবর্তনের আগেই পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করা দরকার। ভারত সে ক্ষেত্রে প্রভাব খাটানোর সুযোগ পাবে না। পাকিস্তানের চলমান প্রভাব ভারতীয় প্রভাবকে নিউট্রালাইজ করবে। পাকিস্তানি বিমান ক্রয়ে ওয়াশিংটন আপত্তি উত্থাপন বা বাধা দেবে না।

রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, ইউনূস প্রশাসনকে ক্রয়ের ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া। মনে রাখা দরকার, ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্ব আর চার বছর। অর্ডারের বিমান পেতেও লাগবে ততধিক বছর। চালান হাতে আসার সময় ট্রাম্প থাকবে না। দরকারে পরের সরকার ইউনূস প্রশাসনের ওপর দায় চাপাতে পারবে। সময় কিন্তু ফুরিয়ে আসছে। এখনই চুক্তি সই করা দরকার। বাংলাদেশেরও আর বিকল্প নেই।

শিবলী আজাদ : ফ্যাকাল্টি, ইংরেজি বিভাগ, লিম্যান কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম