Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার এখনই সময়

Icon

ড. মোস্তফা কে মুজেরী

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার এখনই সময়

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ; পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশ যেমন নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত, তেমনই সম্ভাবনাময় একটি জনপদও বটে। বাংলাদেশের মানুষ সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী। তারা যে কোনো কাজ খুব সহজেই আত্মস্থ করতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তাদের কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে। আমরা যদি বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করতে পারি, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। কোনো দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বা এরও বেশি যখন কর্মক্ষম থাকে, সেই অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একবারই সৃষ্টি হয়। আবার কারও মতে, হাজার বছরে একবার ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। যে দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে পারে, তারাই উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল কাজে লাগিয়ে একটি দেশ কীভাবে উন্নতির শিখরে আরোহণ করে, এর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হচ্ছে চীন। চীন তাদের জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে উন্নতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশই এখন কর্মক্ষম। তাদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ। কিন্তু সেই কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে কর্মসৃজনে নিয়োজিত করতে পারছি না আমরা। তরুণদের অধিকাংশই বেকার অবস্থায় রয়েছে। এমনকি উচ্চশিক্ষিত তরুণদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন বেকার। একজন কর্মক্ষম মানুষের বেকার থাকার মতো যন্ত্রণা আর কিছুতে নেই। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমাদের তেমন কোনো কার্যকর পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। অথচ এ সৃজনশীল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে যদি আমরা উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করতে পারতাম, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত হতো।

বাংলাদেশে যারা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আনুষ্ঠানিক সেক্টরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, তরুণদের মূল উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে সরকারি চাকরিতে নিজেদের নিয়োজিত করা যায়। তারা ঝুঁকি নিতে চায় না। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আনুষ্ঠানিক খাতের অবদান খুবই কম। অনানুষ্ঠানিক খাতে যে উৎপাদন কার্যসম্পাদিত হয়, তার পরিমাণ ফর্মাল জিডিপির ৮০ শতাংশের মতো। এটা নিশ্চিত যে, আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশে বিরাজমান পর্বতপ্রমাণ বেকার সমস্যা দূর করা যাবে না। উন্নয়নের বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে ব্যাপকভিত্তিক আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। একজন তরুণকে উচ্চশিক্ষা লাভের পর সরকারি চাকরি বা আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের পরিবর্তে তাকে অন্যের জন্য কর্মসৃজনের কথা ভাবতে হবে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ অত্যন্ত সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী। তারা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে। দেশের একজন যুবক বা যুবতি যখন বিদেশে কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়, তখন তারা দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু দেশে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সৃজনশীল কাজের জন্য ঝুঁকি গ্রহণ করতে চায় না। কারণ আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা তরুণদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য তেমন একটা অনুকূল নয়। আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরির মাধ্যমে দেশের বেকার সমস্যা দূর করা যাবে না। এজন্য আত্মকর্মসংস্থানের ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে।

পাঠ্যক্রমের একটি নির্দিষ্ট পর্যায় থেকে ছাত্রছাত্রীদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা গেলে তারা শিক্ষাজীবন শেষে সরকারি চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজেরাই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করার মাধ্যমে আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। যারা শিক্ষিত তরুণ, তারা সাধারণত অনানুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করতে চায় না। অনানুষ্ঠানিক খাতে চাকরির পরিবেশ এবং সুযোগ-সুবিধাও পর্যাপ্ত নয়। তাই এ জনগোষ্ঠী চেষ্টা করলেই বিভিন্ন ধরনের উৎপাদনশীল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ গড়ে তুলতে পারে। এতে তাদের যেমন আর্থিক সচ্ছলতা আসবে, তেমনই তারা অন্যদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে।

আমাদের দেশে যে উদ্যমী তরুণ জনগোষ্ঠী আছে, তারা বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে চায়। এক্ষেত্রে আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, সবাই চাইলেই বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে পারবে না। কিন্তু চেষ্টা করলে তারা ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলতে পারে। ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলা সীমিত অর্থায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। ছোট শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসাবে অভিজ্ঞতা অর্জন এবং দক্ষতার পরিচয় দিতে পারলে পরবর্তীকালে তারা বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে পারবে। মনে রাখতে হবে, সবাই উদ্যোক্তা হতে পারে না। উদ্যোক্তা হতে হলে ঝুঁকি গ্রহণের সক্ষমতা থাকতে হয়। ক্ষুদ্র পরিসরে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার মাধ্যমে একজন তরুণ যদি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, তাহলে তার পক্ষে পরবর্তীকালে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

আমাদের দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, দক্ষ ও সৃজনশীল উদ্যোক্তা হতে হলে শিল্পের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কীভাবে তুলনামূলক সস্তায় গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করা যায়, তা জানতে হবে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করা হলেও তা যদি সঠিকভাবে বাজারজাত করা না যায়, তাহলে শিল্পকারখানা লাভজনকভাবে পরিচালিত হতে পারবে না।

দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অর্থায়ন। অধিকাংশ মানুষ স্ব-উদ্যোগে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার মতো অর্থ সংকুলান করতে পারে না। তাই তাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দিতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকগুলো নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের ক্ষেত্রে খুব একটা উদার নয়। তারা চেষ্টা করে কীভাবে আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণদান থেকে বিরত রাখা যায়। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সম্পত্তি বন্ধক দিতে হয়। অনেকের পক্ষেই উপযুক্ত সম্পদ বন্ধক দেওয়া সম্ভব হয় না। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা এ সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন। নারীরা সাধারণত পিতা বা স্বামীর সম্পত্তির অংশ পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা জটিলতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। তারা ইচ্ছা করলেই ব্যাংকের চাহিদামতো সম্পদ বন্ধক দিয়ে ঋণ গ্রহণ করতে পারেন না। বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হিসাবে সাফল্যের পরিচয় দিয়ে চলেছেন। কিন্তু যখনই তারা ব্যাংকে ঋণের জন্য যান, নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হলে ক্ষুদ্র ও তরুণ উদ্যোক্তারা বিকশিত হতে পারে।

আমাদের দেশে যদি কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হয়, তাহলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকশিত করার কোনো বিকল্প নেই। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকশিত করার ক্ষেত্রে আমাদের স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর শিল্প গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। স্থানীয়ভাবে কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তোলা গেলে তা কৃষি খাতের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা শিল্পকে বৃহৎ শিল্পের লিঙ্কেজ শিল্প হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ ক্ষুদ্র শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বৃহৎ শিল্পের কাঁচামাল বা মধ্যবর্তী পণ্য হিসাবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বৃহৎ শিল্পে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হলেও ক্ষুদ্র শিল্পে আনুপাতিক হারে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব কাঁচামাল পাওয়া যায়, তার ওপর ভিত্তি করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠতে পারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির যে উন্নয়ন হয়েছে, তা আমাদের দেশের তরুণদেরও প্রভাবিত করছে। তারা চেষ্টা করলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে থেকে কৃষি ও পল্লি ঋণ নামে এক বিশেষ ঋণদান কার্যক্রম চালু করেছে। এটা সাধারণ কৃষি ঋণের মতো নয়। এ ঋণদানের উদ্দেশ্য হচ্ছে পল্লি এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা গড়ে তোলা, যার কাঁচামাল আসবে কৃষি খাত থেকে। প্রচলিত ব্যাংক ঋণের চেয়ে কৃষি ও পল্লি ঋণের সুদের হার ১ শতাংশ কম। ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য কৃষি ও পল্লি ঋণ কর্মসূচির আওতায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা ঋণদান করার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন শিডিউল ব্যাংক তাদের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ ঋণ বিতরণ করবে। পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে কৃষি ও পল্লি ঋণ গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য যতটা সহায়ক হওয়ার কথা ছিল, ততটা হতে পারছে না। কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণ কার্যক্রম আরও সহজীকরণের মাধ্যমে একে কৃষিবান্ধব করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম জটিল সমস্যা হচ্ছে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারা। ব্যাপকভিত্তিক টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তরুণ উদ্যোক্তাদের বিকশিত করার কোনো বিকল্প নেই। (অনুলিখন : এম এ খালেক)

ড. মোস্তফা কে মুজেরী : অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট; সাবেক মহাপরিচালক, বিআইডিএস

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম