Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রবীন্দ্রনাথের নামে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়!

শান্তি নিকেতনী সংস্কৃতি প্রচারের যৌক্তিকতা কী?

Icon

ফাহমিদ-উর-রহমান

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রবীন্দ্রনাথের নামে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়!

বাংলাদেশ সরকার চলনবিল ভরাট করে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ খবরটা পড়ে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। পেশাগত কাজে বেশ কয়েকবার কলকাতা গিয়েছি। বছর বিশেক আগের কথা। সেবার অ্যাসোসিয়েশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল কলকাতার একটা থিম পার্কে। সেখানে কলকাতার একজন বিখ্যাত শিল্পী এসেছিলেন।

অনুষ্ঠান শেষে যখন বেরিয়ে আসছি, তখন দেখি গাড়ির জন্য শিল্পী অপেক্ষা করছেন। সঙ্গে আমার সহধর্মিণী ছিলেন। সেই তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি বাংলা গান গাইলে না কেন? দু-একটা তো গাইতে পারতে। শিল্পী অনেকটা মুখ গোমড়া করে বললেন, বাংলা গান এসব অনুষ্ঠানে ঠিক চলে না। যদিও এ শিল্পী মাঝে মাঝে বাংলা গানও করেন। এ হচ্ছে কলকাতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাস্তব অবস্থা।

সেবার কলকাতায় কিছুটা ঘোরাফেরা করেছিলাম। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও যাই। এটিকে এখন রবীন্দ্র ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এটি ক্যাম্পাস হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবীন্দ্রনাথের নামে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে। রবীন্দ্রনাথ ভারতের জাতীয় কবি। জাতীয় সংগীতের স্রষ্টাও তিনি। সেদিক দিয়ে বিচার করলে তামাম ভারতবর্ষে বিশেষ করে, রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গে তার ব্যাপারে আগ্রহ এখন অনেক কমে এসেছে। এখন তো রবীন্দ্রনাথের গান হিন্দিতে তরজমা করে গাওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী শিল্পীরাই সেটা করেন। রবীন্দ্র সংগীতের এ দুরবস্থা দেখলে রবীন্দ্রনাথ নিজে কী করতেন, তা বলা মুশকিল।

রবীন্দ্র আধুনিকতার প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। হিন্দি সিনেমা, হিন্দি গান এবং দিল্লির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতাপে রবীন্দ্র আধুনিকতা পিছু হটতে শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে আমাদের এখানে রবীন্দ্র আধুনিকতার প্রতাপকে জিইয়ে রাখার রাজনৈতিক মতলবটা কী? বিশেষ করে পরিবেশের বিপুল বিপর্যয় ঘটিয়ে, চলনবিল ভরাট করে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর সঙ্গে এ মতলব এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ শতকীয় রবীন্দ্র আধুনিকতার সঙ্গে ঢাকার ওপর দিল্লির আধিপত্যের একটা সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া রয়েছে। আওয়ামী লীগের চাপিয়ে দেওয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের খোলসে রবীন্দ্রকেন্দ্রিক আধুনিকতা ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সঙ্গে দিল্লি ও ঢাকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সমন্বয় ঘটেছে। এভাবে রবীন্দ্র আধুনিকতার আড়ালে, ভারত এখানে তার আধিপত্যবাদী অভিসন্ধি কায়েম করে। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের নামে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, এ অভিসন্ধির ফল। বিএনপি সরকার কাজী নজরুলের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর প্রতিশোধ হিসাবে গত ফ্যাসিস্ট সরকার রবীন্দ্রনাথের নামে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয়। যেখানে ভারত সরকার রবীন্দ্রনাথের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে সেখানে আমাদের এখানকার বাঙালি জাতীয়তাবাদী সরকারের এ আয়োজন রীতিমতো বিভ্রম তৈরি করে। এ যেন More Catholic than the Pope-এর মতো অবস্থা। এ কারণেই এ দেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সম্প্রারণ বলা যায়। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদী সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে রবীন্দ্র আধুনিকতার পুনর্মূল্যায়নের প্রশ্ন এসেছে এবং এ দেশের মানুষ রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীতের বিকল্প খুঁজছে। ২০২৪, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানকে তাই রবীন্দ্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বলা যায়। রবীন্দ্র আধিপত্যকে ইতালির মার্কসবাদী পণ্ডিত আন্তোনিও গ্রামশির ভাষায় হেজিমনি বললে ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানকে কাউন্টার-হেজিমনি বলতে হবে।

কয়েকদিন আগে দেখলাম শাহজাদপুরে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের সংঘর্ষে সেখানকার রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীর একটি জানালা ভেঙে যায়। এ নিয়ে আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজনরা মাতম শুরু করলেন। রবীন্দ্র তীর্থের এ অপমান হজম করা এদের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠল। এদের কাছে ধর্মস্থানের চেয়েও রবীন্দ্র তীর্থের মর্যাদা অনেক বেশি। এমন কথাও তারা বললেন, এখানেই নাকি ছিন্নপত্র লেখা হয়েছিল। প্রথম কথা হলো, এ বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজনরা কোন মানদণ্ড অনুসারে বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজন হয়েছেন তা বোঝা গেল না। দ্বিতীয়ত এখন যেসব কুঠিবাড়ীকে রবীন্দ্র তীর্থ বানানো হয়েছে এগুলোতো আসলে তহশিল অফিস। জমিদাররা এখানে বসে দরিদ্র প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। যথাসময়ে খাজনা না দিতে পারলে প্রজাদের ধরে এনে এখানেই তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হতো। ঠাকুর জমিদাররা ছিলেন খুবই অত্যাচারী। প্রজাপীড়ন সব খাজনা আদায়ে তাদের সুনাম কারও চেয়ে কম ছিল না। এ কারণে কয়েকবার ঠাকুর জমিদারিতে প্রজাবিদ্রোহ হয়। ঠাকুররা সে বিদ্রোহ নিষ্ঠুরভাবে দমন করে। ঠাকুর জমিদারদের এসব অত্যাচারের কথা কুষ্টিয়ার সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিণাথ রেকর্ড করেন এবং এসবের সমালোচনাও করেন। এ কারণে রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিরুদ্ধে গুন্ডা লেলিয়ে দেন। অথচ আমাদের বিশিষ্টজনরা রবীন্দ্রনাথকে মানবিক জমিদার বলানোর চেষ্টা করেন। ইতিহাসের রেকর্ড কিন্তু তা বলে না।

রবীন্দ্রনাথ এসব কুঠিবাড়ীতে বসে অনেক লেখালেখি করেছেন। ছিন্নপত্রও তার একটি। ছিন্নপত্র হচ্ছে প্রধানত তার ভাতিজি ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠির সংকলন। এসব চিঠিতে তার কুঠিবাড়ীর জীবনের কথা আছে, পূর্ব বাংলার প্রকৃতির কথা আছে। তার ব্যক্তিগত আবেগ, আকাঙ্ক্ষার কথা আছে। কিন্তু এসব লেখালেখিতে তার দরিদ্র কৃষক, মুসলমান প্রজাদের কথা কখনো উঠে আসেনি। জমিদার হিসাবে তিনি এসব প্রজাদের খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তাদের দুঃখ-দারিদ্র্য-অভাব-অনটন তার মনে কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। অথচ এদের খাজনার টাকায় তার সংসার চলত। তার ব্যয়বহুল বিদেশযাত্রার টাকা-পয়সাও এ টাকা থেকেই উসুল হতো।

রবীন্দ্রনাথ গোরার মতো উপন্যাস লিখেছেন। এর নায়ক একজন অবৈধ সন্তান। অবৈধ সন্তানকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন এই কারণে তার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ইন্টারেস্ট গ্রো করেছিল। কৃষক মুসলমানদের নিয়ে তার কোনো ইন্টারেস্ট গ্রো করেনি। এজন্য তিনি তাদের নিয়ে কিছু লেখেননি। অথচ এ কৃষক মুসলমানরাই কালে, কালে একটা রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলল। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফ লিখেছেন, ঠাকুর জমিদারদের প্রজাহিতৈষিতার কোনো ইতিহাস নেই। জমিদারিতে তারা কোনো প্রাইমারি স্কুল বা দাতব্য চিকিৎসালয়ও প্রতিষ্ঠা করেননি। এমনকি একটা দিঘিও খনন করেননি। এ কারণেই আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের আকাশে ঈদ-মহররমের চাঁদ ওঠেনি। সে চাঁদ ওঠাবার ভার ছিল কাজী নজরুল ইসলামের ওপর। এটাই বাস্তবতা।

রবীন্দ্রনাথ কোনোকালেই বাঙালিদের জন্য রাষ্ট্র চাননি। তিনি ছিলেন ভারতপথিক। বাংলা ভাষায় তিনি লিখেছেন বটে; কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন অখণ্ড ভারতপন্থি। হিন্দিকে করতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্রভাষা। তার বাঙালিত্ব ও ভারতীয়ত্বের ভেতরে কোনো বিরোধ ছিল না। এ জন্য তিনি দুটোই একসঙ্গে প্রচার করেছেন।

আমরা জিন্নাহ সাহেবকে দোষ দেই। তিনি আমাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। এ জন্য উর্দুওয়ালাদের আমরা ক্ষমা করিনি। কিন্তু হিন্দিওয়ালাদের ব্যাপারে আমাদের বিশিষ্টজনদের নীরবতা দেখে অবাক হই। শুধু তাই নয় হিন্দিওয়ালা রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সংস্কৃতির ঋষি হয়ে বসে আছেন।

রবীন্দ্রনাথের যে গানটি আমাদের জাতীয় সংগীত সেটা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে কৃষক বাঙালি মুসলমানদের জন্য কিছু সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এতে কলকাতার হিন্দু এলিটরা খেপে গিয়ে আন্দোলন শুরু করে। রবীন্দ্রনাথও তার মধ্যে ছিলেন। সে সময় তিনি দুই বাংলা এক বানাবার জন্য ওই সংগীতটি লেখেন। এটা বাংলাদেশকে অস্বীকার করে লেখা হয়েছে। এ গানের নৈতিক ভিত্তি শুধু দুই বাংলা একত্র হলেই অর্জন সম্ভব। সেটা কি কোনো বাস্তব চিন্তা? যে কবি বাংলাদেশের মানুষের জন্য তেমন কিছু লেখেননি বা তাদের কোনো উপকার করেননি তার লেখা গান জাতীয় সংগীত বানানো কতটুকু সংগত কিংবা কোটি কোটি টাকা খরচ করে তার নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আড়ালে, শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতি প্রচারের যৌক্তিকতা কি? এটা নিয়ে অবশ্যই আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। এদেশের ভারতজীবী, বুদ্ধিজীবীদের কথায় আমাদের জাতি ও সংস্কৃতি প্রশ্নের সমাধান হবে না। রবীন্দ্র চিন্তা প্রবাহ দিয়ে বাঙালি মুসলমানের পক্ষে তার নিজস্ব জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়। এতে করে বাঙালি মুসলমানের তামুদ্দুনিক আজাদী যেমন থাকবে না, তেমনি সেই পথ ধরে রাজনৈতিক আজাদীও বিপদের মধ্যে পড়বে।

ফাহমিদ-উর-রহমান : চিকিৎসক ও গবেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম