লজিক্যাল ফ্যালাসির বাস্তব প্রভাব
তাইফুর রহমান
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যুক্তিগত বিভ্রান্তির (Logical Fallacy) বাস্তব জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও বিপজ্জনক প্রভাব রয়েছে। এগুলো শুধু তর্কে ভুল সৃষ্টি করে না, সে সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জনমত গঠন, রাজনীতি, গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, বিচারব্যবস্থা এমনকি ব্যক্তিগত ও করপোরেট সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
লজিক্যাল ফ্যালাসি এমন এক জটিল ধারণা, যা রাজনীতি ও জনমত গঠনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। নেতারা বা রাজনৈতিক প্রচারকরা প্রায়ই Ad Hominem, Straw Man বা False Dilemma ব্যবহার করেন। যেমন একজন প্রার্থী বলছেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশপ্রেমিক না।’ অথচ যুক্তি দেওয়া হয়নি, কেন তিনি তা নন। এতে মানুষ বাস্তব ইস্যু বাদ দিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে ভোট দিতে পারে। বিভক্তি তৈরি হয়, ভুয়া প্রচারণা বাস্তব সত্যকে চাপা দেয় এবং জনগণ ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তিগত বিভ্রান্তি যদি বিচারব্যবস্থায় ঢুকে পড়ে, তাহলে নির্দোষ মানুষ দোষী সাব্যস্ত হতে পারে বা দোষী মানুষ ছাড় পেতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে ‘এই ব্যক্তি আগেও গ্রেফতার হয়েছে, তাই এখন সে অবশ্যই দোষী।’ এটা এক ধরনের জেনেটিক ফ্যালাসি। অতীত রেকর্ড থাকলেই যে সবসময় দোষী হবে, তা নয়।
গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্য ছড়ানো বর্তমান দুনিয়ায় সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। মিডিয়ায় আকর্ষণীয় হেডলাইন বা মিথ্যা তুলনা করে মিথ্যা বার্তা ছড়ানো হয়। মনে করুন কেউ মন্তব্য করল ‘টিকা নেওয়ার পরও লোকটি মারা গেছে। টিকা কোনো কাজেই লাগে না।’ এটা হচ্ছে Post hoc fallacy, যেখানে টিকাকে মৃত্যুর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। মৃত্যুর সঙ্গে টিকার সম্পর্ক না থাকলেও এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন কারণ-ফলাফল আছে। প্রচারণায় Appeal to Emotion বা Appeal to Authority ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
বলা হয়ে থাকে যে, ‘এই ক্রিমটা নিলে তুমি বলিউড নায়িকার মতো সুন্দর হয়ে যাবে।’ বিজ্ঞাপনে বাস্তব কার্যকারিতা নয়, তারকা ব্যবহারে আবেগ সৃষ্টি করা হয়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হতে পারে বিভিন্ন যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে যুক্তি মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস মাত্র। তর্কে যদি যুক্তিগত বিভ্রান্তি থাকে, তাহলে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে এমন যদি বলা হয়ে থাকে যে ‘তুমি আমার ফোন ধরো না, মানে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ভালোবাসো না।’ এতে ভুল বোঝাবুঝি থেকে সম্পর্ক ভাঙতে পারে। অনেক ভুয়া বিজ্ঞান বা চিকিৎসাসম্পর্কিত ধারণা তৈরি হয় Fallacy দিয়ে। কেউ যদি বলে ‘আমার চাচা তেল মাখে, সে কখনো অসুস্থ হয় না। তাই এই তেলেই সব রোগ সারে।’ এ ধরনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে সাধারণ নিয়ম তৈরি করা বিপজ্জনক হতে পারে।
করপোরেট দুনিয়ায় যুক্তিগত বিভ্রান্তির (Logical Fallacy) শিক্ষা একটি অত্যন্ত বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কর্মক্ষেত্রে ভুল যুক্তির ব্যবহার শুধু ভুল সিদ্ধান্তই নয়, বরং কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি, নেতৃত্ব, এবং পারস্পরিক সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নেতৃত্বে যুক্তির স্বচ্ছতা জরুরি। ‘বস বলেছেন, তাই এটা ঠিক।’ একজন নেতা ভুল করতেই পারেন। শুধু পদমর্যাদার ভিত্তিতে যুক্তি মেনে নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রশ্ন তোলা এবং খোলামেলা আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। দলীয় আলোচনা মানেই সত্য নয়- ‘সবাই তো এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছে, তুমিই কেন প্রশ্ন তুলছ?’
জনপ্রিয়তা মানেই যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত নয়। ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা ও minority voice শুনে কাজ করা অনেক সময় টিমের মান বাড়ায়। কর্মী মূল্যায়নে পক্ষপাত এড়াতে হবে-‘ও তো আগেও ভুল করেছে, ওর কোনো মতামত গুরুত্বহীন।’ অতীতের ভিত্তিতে একজনের বর্তমান দক্ষতা অস্বীকার করা ভুল। পারফরম্যান্স পর্যালোচনায় যুক্তি, প্রমাণ ও বাস্তব ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
বিজ্ঞাপন ও মার্কেটিংয়ে নৈতিকতা-‘আপনি যদি আমাদের প্রোডাক্ট না ব্যবহার করেন, তাহলে হয়তো আপনার সন্তান নিরাপদ নয়!’ ভয় বা আবেগ দিয়ে বিক্রি করাও একটি বিভ্রান্তিকর কৌশল। স্বচ্ছতা ও তথ্যভিত্তিক মার্কেটিং দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়। দলীয় রাজনীতি ও অফিস রাজনীতিতে সতর্কতা বজায় রাখা উচিত। সহকর্মীর প্রস্তাব বিকৃত করে সেটার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এক ধরনের হঠকারিতা। প্রকৃত বক্তব্য ও প্রস্তাবের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারলেই সুস্থ পরিবেশ গড়ে ওঠে। করপোরেট সংস্কৃতিতে যুক্তিগত বিভ্রান্তিগুলো শনাক্ত ও এড়িয়ে চললে সঠিক ও তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়, দলগত কাজের মান বাড়ে এবং কর্মক্ষেত্র হয় অধিকতর নৈতিক ও প্রগতিশীল। যুক্তিগত বিভ্রান্তি যেন না ঘটে, এজন্য সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (critical thinking), তথ্য যাচাই (fact-checking) এবং যুক্তির কাঠামো বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিভ্রান্তি বুঝে ফেলতে পারলেই আমরা অনেক ভুল সিদ্ধান্ত ও প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে পারি।
ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক
