Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

বিলুপ্তির পথে দক্ষিণ বাংলার নৌকাবাইচ

Icon

বাহাউদ্দিন গোলাপ

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলা এক নদীমাতৃক স্বপ্নভূমি-যার হৃদয়ে বয়ে চলেছে অগণন জলধারা। তারই দক্ষিণভাগ, যাকে আমরা ‘দক্ষিণ বাংলা’ নামে চিনি-বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর-এ জনপদের শিরা-উপশিরায় বহমান কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা, বলেশ্বর, তেঁতুলিয়া, সুগন্ধা, বিষখালী, আড়িয়াল খাঁ, গাবখান, পশুর ও বুড়িশ্বর নদী। এ নদীগুলোর তীরে গড়ে উঠেছে মানুষের বসতি, পল্লিজীবনের এ প্রাচীনপরম্পরা যেন কৃষ্টি আর লোকজ সংস্কৃতির রঙিন এক আলপনা। আর এ আলপনার একটি প্রাণময় রেখা ছিল-‘নৌকাবাইচ’। এটি কেবল একটি প্রতিযোগিতা ছিল না, ছিল এক মিলনোৎসব, আনন্দোচ্ছ্বাসের নিখাদ বহিঃপ্রকাশ; নদীরকূলে গড়ে ওঠা গ্রামীণ জীবনের প্রাণান্ত এক উৎসব, যাকে ঘিরে হাসি, স্লোগান, প্রতিযোগিতা আর লোকনাট্যের গাঁথা তৈরি হতো।

শ্রাবণ-ভাদ্রের বর্ষায় যখন নদীগুলো উপচে পড়ত ভরা যৌবনের মতো, যখন বাতাসে মাটির কাদা গন্ধ মিশে যেত নূপুরের সুরে-তখনই বাঙালির এ প্রাচীন উৎসবে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত গ্রামে গ্রামে। গাঁয়ের তরুণরা নেমে পড়ত প্রস্তুতিতে। কেউ নৌকা সাজায়, কেউ স্লোগান তোলে, কেউবা গলায় বাঁধে রঙিন গামছা আর হাতে তুলে নেয় বৈঠা। নদীর তীরে তক্তা পেতে ঢাক-ঢোল-সানাইয়ে গানের সুর তোলে, শিশু থেকে বৃদ্ধ-সবাই মেতে ওঠে বাঁধভাঙা আনন্দে।

নৌকাবাইচের এ আয়োজন ছিল পাড়ায় পাড়ায় সামাজিক সংহতির অনন্য এক অনুশীলন। প্রতিযোগিতার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি কিংবা ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। পুরস্কারও হতো মনকাড়া-গরু, কাপড়, সিল্ড কাপ কিংবা নগদ অর্থ। কখনো কখনো নৌকাবাইচ আয়োজন হতো মেলা ঘিরে। হাট বসত, গীতিনাট্য হতো, গ্রামীণ বাজারে যোগ হতো ব্যতিক্রমী উৎসবের ছোঁয়া। বিভিন্ন অঞ্চলের নৌকাবাইচে ছিল নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। বরিশালের বাইচে দেখা যেত দীর্ঘ ও সরু ‘সাপ নৌকা’, যা ছুটে চলত নদীর ঢেউ চিরে। ফরিদপুর বা গোপালগঞ্জের বাইচে থাকত অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত কাঠের নৌকা-মজবুত কাঠামো আর নান্দনিক কারুকার্যে ভরপুর। পালাগান, কৌতুক, দলীয় স্লোগান ও অভিনব সাজসজ্জা-সব মিলিয়ে এটি ছিল এক ধরনের জলের মঞ্চনাট্য, যার পটভূমি ছিল আমাদের প্রাণের নদী।

কিন্তু সেই দিন আজ যেন নদীর মতোই শুকিয়ে আসছে। দখল, দূষণ আর প্রশাসনিক উদাসীনতায় দক্ষিণ বাংলার নদীগুলো হারাচ্ছে প্রবাহ, হারাচ্ছে প্রাণ। আধুনিক প্রযুক্তি ও নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতায় গ্রামীণ ঐতিহ্যগুলো হয়ে উঠেছে অবহেলিত। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই নৌকাবাইচ সম্পর্কে জানে না। তাছাড়া কোথাও কোথাও লোকসংস্কৃতির স্মরণে ক্ষণস্থায়ী আয়োজন হলেও তাতে থাকে না আগের সেই প্রাণ, সেই ঐক্যের আলো। ফলে, নৌকাবাইচও হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে, স্মৃতির পাতায় ধূলিধূসর এক অধ্যায়ে।

এই সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে যেমন সময় ও প্রযুক্তির আধিপত্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে সামাজিক ও প্রশাসনিক উদাসীনতা। নৌকাবাইচের মতো হাজার বছরের ঐতিহ্যকে কেবল ‘লোকখেলা’ হিসাবে দেখলে চলবে না, একে মূল্যায়ন করতে হবে জাতিগত সংস্কৃতির অংশ হিসাবে-একটি জীবন্ত ঐতিহ্য হিসাবে, যা সমাজের চেতনায় আলো ছড়াত। এই ঐতিহ্য রক্ষায় প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাব, গণমাধ্যম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এক কাতারে এসে কাজ করতে হবে। নদীর মতোই সংস্কৃতি-প্রবহমান না থাকলে তা শুকিয়ে যায়। যদি আজ আমরা এটিকে ফিরিয়ে না আনতে পারি, তবে একদিন হয়তো কেবল ছবির পাতায় বেঁচে থাকবে এ অনন্য লোকঐতিহ্য-যার সুর আমরা শুনব না, শুধু কল্পনায় অনুভব করব।

ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম