Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

নারীর পরিচয়

Icon

আনোয়ারা নীনা

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নারী- একজন মা, একজন অভিভাবক, একজন স্ত্রী, একজন গৃহিণী, একজন উপার্জনশীল ব্যক্তি, একজন রাঁধুনি, একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, একজন বন্ধু...। প্রশ্ন হল, এতকিছুর পরও কি আমরা খুঁজে পেয়েছি তার আসল পরিচয়?

নারীরাও সৃষ্টির সেরা জীব। তারপরও তাকে সব সময় সব কিছুতেই আপস করে চলতে হয়। হতে পারে সংসার জীবনে, হতে পারে কর্মক্ষেত্রে এবং হতে পারে সেটা ব্যক্তিগত জীবনে। সব জায়গাতেই নারী নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে আপসকামী হয়ে। কিন্তু তারপরও কি পাচ্ছে তার যথাযথ মর্যাদা? ফলে দিনের শেষে একজন নারীকে দেখা যায় খুঁজে বেড়াচ্ছে- কী তার আসল পরিচয়!

নারীর নিজের পরিচয় আড়াল করতে সমাজ, ধর্ম, আইন- কত না পদ্ধতি, কত না ব্যবস্থা রয়েছে! অনেক নারী বোঝে হোক বা না বুঝে হোক- অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হতে ভালোবাসে। একজন নারীর নামের শেষে স্বামীর নামের অংশ জুড়ে দেয়া হয় অথবা নারীর নামের আগে স্বামীর নামের একাংশ জুড়ে দেয়া হয়। যেমন স্বামীর নাম হয়তো হুমায়ূন কবীর; স্ত্রীর নাম সার্টিফিকেট অনুযায়ী আয়েশা আফরোজা অথচ পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখছেন- আয়েশা কবীর। দেখা গেল, অন্য আরেকজনের নাম আইরিন ফারহানা। তার স্বামীর নাম সিদ্দিকুর রহমান। এ থেকেই তিনি নিজের নাম লিখতে শুরু করেছেন ফারহানা রহমান। তাদের মাথায় বাবা-মা’র নামের অংশ জুড়ে দেয়ার চিন্তা নেই। তবে কি বলব- ভালোবাসায় আপস করছি? বুঝে উঠতে পারি না। কারণ এমন নজির এখনও তৈরি হয়নি- কোনো স্বামী তার স্ত্রীর নামের কোনো অংশ নিজের নামে জুড়ে দিয়েছেন বা কোনোদিন জুড়ে দেবেন! এটা কি কোনো প্রথা? এজন্য দায়ী কি আমাদের শিক্ষা? নিশ্চিত হয়েই বলা যায়, কোনটাই না। দায়ী হল, বিভ্রান্ত মানসিকতা।

নারী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও পারে না টিকিয়ে রাখতে। একজন নারী মারা যাওয়ার পর কবরের নামফলকে লেখা হয় মৃত্যুবরণকারীর নাম; তারপর স্বামীর নাম। বাবার নাম লেখা হয় না! কোনো পুরুষ মারা যাওয়ার পর কি সেখানে তার নামের নিচে স্ত্রীর নাম লেখা হয়? সেখানে তার বাবার নামই লেখা হয়। ইদানীং সন্তানের মায়ের পরিচয় লেখা হলেও সব ক্ষেত্রে সুসংগঠিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এখনও সুদূরপ্রসারী। পশ্চিম ইউরোপ, বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোয় মেয়েরা ডাবল আফটার নেইম ব্যবহার করে। তাদের সন্তানের ক্ষেত্রেও উভয়ের আফটার নেইম দিয়ে নাম রেজিস্ট্রি করা হয়। কেউ নাম বদল করছে না; যে যার নাম বহন করছে।

একজন নারী যদি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে; তবে সে হয়ে যায় অযোগ্য। কারও স্ত্রী যদি গৃহিণী হয় এবং ওই ব্যক্তিকে যদি প্রশ্ন করা হয়- আপনার স্ত্রী কী করেন? উত্তর দেয়া হয়- কিছুই করে না! এটাই কি সঠিক উত্তর? যদি এই স্বামীকেই আবার প্রশ্ন করা হয়- আপনার সন্তানদের কে দেখাশুনা করে? উত্তর হবে, ওনার স্ত্রী। যদি প্রশ্ন করা হয়- আপনার সংসার কে সামলায়? উত্তর হবে, ওনার স্ত্রী। সন্তানের লেখাপড়ার দেখভাল কে করেন? এ প্রশ্নের উত্তরও হবে, ওনার স্ত্রী। যদি প্রশ্ন করা হয়- আপনি বা আপনার সন্তান অসুস্থ হলে পরিচর্যা করেন কে? উত্তর হবে, ওনার স্ত্রী। তাহলে কে এই স্ত্রী, যিনি কিছুই করেন না! আর কী-কী করলে তবে সেই নারীর কিছু করা হবে!

নারীর ভালোবাসা, নারীর ত্যাগ, নারীর আপস- সবই যেন অন্ধের মতো। কিন্তু এই অন্ধের মতো ভালোবাসা অন্ধের মতো সবকিছুর প্রতি দুর্বলতা যেন না হয়। প্রেমিক-প্রেমিকার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটতে দেখা যায়। যেন প্রেমটাকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব কেবল নারীর। এক্ষেত্রে পুরুষের আচরণটা যেন এমনটি না হয়- তুমি ভালোবাসো বলেই আমি ভালোবাসছি।

ইসলাম নারীকে দিয়েছে শ্রেষ্ঠ সম্মান। কিন্তু জন্মের সময় আবার খুশির ক্ষেত্রে দু’রকম বিধান। ছেলে সন্তান হলে আকিকার ক্ষেত্রে দুটো পশু জবাই করার বিধান। আবার মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে একটি পশু জবাইয়ের কথা বলা হয়েছে। তাই বলে এখানে অবজ্ঞা বোঝানো হয়নি; বরং ইসলামে রয়েছে- মহান আল্লাহতা’য়ালা যখন কাউকে কন্যাসন্তান দেন; তার প্রতি অধিক সন্তুষ্ট হয়েই দেন। আমাদের সমাজে এখনও দেখা যায়- কন্যাসন্তানকে কম লেখাপড়া করিয়েই বাল্যবিয়ে দেয়া হচ্ছে। এজন্য তাকে সহ্য করতে হচ্ছে পরিবার ও সমাজের রক্তচক্ষু। তার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ নেই। তাকে তখন বেঁচে থাকতে হয় পরিচয়হীন (!) গৃহবধূ হয়ে! সেখানে সে কারও প্রিয় হতেও পারে; আবার নাও হতে পারে।

আর তখনই শুরু হয় কঠিন আপসনামায় স্বাক্ষর। এই আপস কারও জন্য বাধ্যতামূলক, কারও জন্য দায়িত্ববোধ, কারও জন্য স্রেফ দায়। দেখা যায়- আপস না করলে অনেকের জীবন হয়ে পড়ে অস্তিত্বহীন। অথচ রাসূলুল্লাহর (সা.) পারিবারিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- তিনি তার স্ত্রীদের জন্য আলাদা আলাদা বাসস্থান নির্মাণ করেছিলেন। প্রত্যেকে নিজের গৃহের কর্তৃত্ব বজায় রেখে নিজস্বতা ও স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন। দায় বা দায়িত্ববোধ কারও উপর চাপিয়ে দেয়া হয়নি। তাই কাউকে কোনো আপসনামায় স্বাক্ষর করতে হয়নি। রাসূল (সা.) নারীদের বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন বলেই এমনটি প্রকাশ পেয়েছে। পবিত্র কোরআন শরিফে বলা হয়েছে- তোমরা সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেরা যেরূপ গৃহে বাস করো; স্ত্রীদের বসবাসের জন্য তদ্রূপ গৃহের ব্যবস্থা করে দাও। তাদের কষ্ট দিয়ে জীবন সংকটাপন্ন করো না। (সুরা তালাক, আয়াত : ৬)

প্রধান শিক্ষক

হালিমুন্নেছা চৌধুরানী মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ভালুকা, ময়মনসিংহ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম