|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কবে, কখন, কোন ছোটবেলায় প্রথম শুনেছিলাম-হেমলক বিষ পান করিয়ে সক্রেটিসকে হত্যা করা হয়েছিল; সে কথা আজ আর মনে নেই। হেমলক শব্দটিকেই আজন্ম শত্রু জেনে এসেছি। সক্রেটিসের জন্য গভীর বেদনা অনুভব করেছি। হেমলক মানেই সক্রেটিসের ঘাতক। হেমলক শব্দটি হয়ে ওঠে বিষাক্ত বিষের প্রতিশব্দ। ধুতরা ফুল বিষাক্ত; তবুও ধুতরা ফুলের শুভ্রতা মুগ্ধ করে যে কাউকে। বাড়ির আনাচে-কানাচে অবহেলায় ফুটে থাকে ধুতরা ফুল। ধুতরা ফুলের দিকে কোনোদিন ঘৃণাভরে তাকাইনি; বরং সমীহ করেছি মনে মনে। বুকের ভেতরে বিষ লুকিয়ে রেখে কেমন সুষমা ছড়ায়; অথচ ভয়ে কেউ কাছে যায় না। ধুতরার দিকে এই যে পক্ষপাতিত্ব, তার কারণ ধুতরা ফুলকে চিনি বলে। ধুতরা ফুলের গায়ে লেগে নেই কোনো কলঙ্ক। ধুতরার বিষ প্রয়োগ করে মানুষ মারার কোনো গল্প নেই মানব ইতিহাসে।
হেমলক বিষপানে সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে। মৃত্যুদণ্ডের ২৪১৫ বছর পর গ্রিসের একটি আদালত রায় দিয়েছে সক্রেটিস নির্দোষ। ক্ষমতাসীনরা কখনোই সত্য, যুক্তি, ন্যায় এসব বোঝে না। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সব তিনি যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছিলেন; তারপরও তাকে বিষপানে হত্যা করা হয়। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটোর ডায়লগে ডায়লগ আকারে বর্ণিত আছে সে ট্র্যাজেডি। সক্রেটিস বাজারে, লোকালয়ে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন; মানুষের ভেতরের মানুষটিকে জাগিয়ে তোলার জন্য প্রশ্ন করতেন। প্রশ্ন করে মানুষের মুখ থেকেই তার উত্তর বের করে আনতেন। মানুষকে জাগিয়ে দিলে ক্ষমতাসীনদের অনেক অসুবিধা; তাই দার্শনিককে বন্দি কর, কণ্ঠরোধ কর, হত্যা কর-এটাই চলে আসছে ইতিহাসের শুরু থেকে। সক্রেটিস বলেছিলেন, নিজেকে জান। আমি বলব, কেউ যদি নিজেকে জানতে চায়, সে যেন কিছুটা হলেও সক্রেটিসকে জানে। গুগলে সক্রেটিস লিখে সার্চ দিলে যতটুকু তথ্য জানা যায়, সেটুকু অন্তত একজন মানুষ যেন তার সম্পর্কে জানে।
যুক্তরাজ্যের নর্দামবারল্যান্ডে আছে দ্য পয়জন গার্ডেন বা বিষের বাগান। বিষাক্ত গাছের অনন্য এক সংগ্রহ। সেখানে আছে হেমলক গাছ। হেমলকের দ্বিপদী নাম কনিয়াম ম্যাকালেটাম। ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকাসহ যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় গাজর পরিবারভুক্ত এপিয়াসিরাইয়ের একটি বিষাক্ত বহুবর্ষজীবী সপুষ্পক উদ্ভিদ। হেমলক গাছে গুচ্ছাকারে ছোট ছোট সাদা ফুল ফোটে, কাণ্ডে বেগুনি ছোপ দেখা যায়। হেমলক গাছ ৯ ফুটের মতো লম্বা হয়। হেমলক মূলত বসন্তে জন্মে; তবে কোথাও কোথাও বছরজুড়ে দেখা যায়। দৃষ্টিনন্দন এ গাছটি একসময় ইউরোপে গার্ডেন প্লান্ট হিসাবে চাষ হতো। পুরো গাছটিই তীব্র বিষময়; যেমন বীজ, ফুল, পাতা ও মূল। এর অল্প পরিমাণ বিষও মৃত্যু ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। রাসায়নিক সংকেত C8H17N. কোনিইন নিউরোটক্সিন জাতীয় বিষ। এটি আক্রান্ত প্রাণীর দেহের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। নিউরো মাসকুলার জাংশন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় স্নায়ুর সঙ্গে পেশির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পেশিকোষ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত প্রাণীর তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়।
হেমলক ‘ডেডলি হেমলক’, ‘পয়জন পার্সলে’, ‘ক্যালিফোর্নিয়া ফার্ন’ ও ‘স্পটেট হেমলক’ নামেও পরিচিত। এখন পর্যন্ত বিষক্রিয়ার কোনো চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা করা হয়। এ গাছ কখনো পোড়ানো উচিত নয়। গাছ পোড়ানোর ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট হতে পারে। গ্লাভস, ফেস মাস্ক এবং প্রতিরোধমূলক পোশাক পরে এটি অপসারণ করা উচিত। সৃষ্টিশীল লেখকের সাহিত্যকর্মে হেমলক বিষের উল্লেখ পাওয়া যায়। শেকসপিয়ারের কিংলিয়ার, হ্যামলেট ও ম্যাকবেথ নাটকে হেমলক বিষের উল্লেখ যেমন আছে; তেমনি কলকাতায় পরিচালক সৃজিত মুখার্জি নির্মাণ করেছেন হেমলক সোসাইটি নামে একটি সিনেমা, যা দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।
ব্যাংকার, সবুজবাগ, ঢাকা
