নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধে চাই গণসচেতনতা
নাসির উদ্দিন
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নারী ও শিশু পাচার একটি সামাজিক সমস্যা। স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশ যদিও উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে এসেছে; তথাপি নারী ও শিশু পাচার একটি জটিল সামাজিক সমস্যা ও অর্থ উপার্জনের জঘন্য উৎস হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। শিশু পাচারের মতো জঘন্য কাজটি যে কতভাবে সংঘটিত হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বল্পোন্নত দেশের জনগণের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির অসাধু মানুষ পাচারের কাজে লিপ্ত হয়। মধ্যযুগে মানুষকে যেভাবে ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে পাচারের মাধ্যমে ঠিক তেমনিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাচারকৃত শিশুদের পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। পাচারের কারণে শিশুর সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারের সুখ-শান্তি, আশা-আকাঙ্ক্ষাও শেষ হয়ে যায়।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মতো বাংলাদেশও জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে। তারপরও এ দেশের শিশুরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্বের সুযোগে একটি চক্র নারী ও শিশু পাচারের মতো জঘন্য কাজটি করে থাকে। এসব পাচারকারীচক্র নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। পাচারকারীরা পাচারের সময় নানাকৌশল যেমন: অপহরণ, প্রেম-ভালোবাসার ফাঁদ, সাজানো বিয়ে, ভালো চাকরির প্রলোভন, পুনর্বাসনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, প্রতিপালন করার প্রলোভন, আর্থিক সাহায্যের প্রলোভন, ভালো খেলনার প্রলোভন ইত্যাদি অবলম্বন করে থাকে।
গত ১০ বছরে শুধু ভারতেই প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশি নারী ও শিশু পাচার হয়েছে, যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১২ থেকে ৩০ বছর। বাংলাদেশের যত শিশুর ক্ষেত্রে মিসিং বা ট্রাফিকিংয়ের ঘটনা ঘটে, এর মাত্র ২৭ শতাংশ দৈনিক পত্রিকায় ও ১২ শতাংশ টিভি নিউজে দেখা যায়। বিদেশি একটি চক্র দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় এক শক্তিশালী পাচার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যারা নারী-শিশুসহ কিডনি পাচারে সক্রিয়। প্রতিবছর ২০ হাজার নারী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যায়।
এশিয়ার মধ্যে নারী পাচারের ঘটনার দিক থেকে নেপালের পরেই বাংলাদেশের স্থান। পাচারকারীরা স্থল, পানি বা আকাশপথে নারী ও শিশু পাচার করে থাকে। বাংলাদেশ থেকে পাচারের যে ঘটনাগুলো ঘটে, তাতে দেখা যায়, বিমানযোগে কিছু পাচার হয়, তবে স্থলপথে সীমান্ত অতিক্রমের মাধ্যমেই বেশিসংখ্যক নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে। এ দেশের সঙ্গে ভারতের ৪ হাজার ২২২ এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর সীমানা দিয়েই পাচার হয় বেশি। যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার শাকারা, ভোমরা, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, কক্সবাজার, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছয়টি রুটসহ অন্তত ১৮টি রুট দিয়ে আশঙ্কাজনকহারে পাচার হচ্ছে নারী ও শিশু।
সম্প্রতি টিকটক, লাইকি, ফেসবুক, ইমো, ভাইবার, ডিসকড, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে পাচারের জন্য নারীদের সংগ্রহ করা হচ্ছে। নিজস্ব দালাল নিয়োগ করেও নানা কৌশলে এ দেশ থেকে নারীদের পাচার করে দেওয়া হচ্ছে ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, কাতার, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, এরকম ৩০টি বা তারও বেশি চক্র সারা দেশে বিস্তৃত রয়েছে। কিছু চক্র নারীদের গৃহপরিচারিকার চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচার করছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
শিশু ও নারী পাচারকারীদের জন্য কঠোর আইন রয়েছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে পাচারকারীদের বিচারের মুখোমুখি করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া সম্ভব হলে পাচার দমন করা সহজ হবে। বাংলাদেশের দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০-সহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোর সার্বিক বাস্তবায়নে আমাদের কঠোর দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা কিংবা সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত, তাদের পাচারবিরোধী কার্যক্রমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। কোনো শিশুকে পাচারকারীর হাত থেকে উদ্ধার করার পর তার পুনর্বাসনের বিষয়টি অধিক গুরুত্বপুর্ণ। শিশুটিকে তার সমাজ বা তার পরিবার যেন স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে, তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিশুটির স্বাভাবিক বিকাশ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২০২২-এ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তঃসীমান্ত মানব পাচার মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূমিকা কেমন হবে, তার একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে এ উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কিছু কার্যক্রম প্রস্তাব করা হয়েছে এবং এসব কার্যক্রম গ্রহণ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে সমন্বয় ও তদারকি, প্রতিবেদন তৈরি এবং মূল্যায়নের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এবারের কর্মপরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এসডিজি ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া এ কর্মপরিকল্পনায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনের লক্ষ্যে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের অংশ হিসাবে মানব পাচার প্রতিরোধের জন্য আলাদা কর্মসূচি, পাচারের শিকার ব্যক্তির সুরক্ষা ও তার পুনরেকত্রীকরণের জন্য আলাদা কর্মসূচি, পাচারের শিকার ব্যক্তির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং পাচারকারীকে আইনের আওতায় আনার জন্য কার্যক্রম গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। একইভাবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনের জন্য সব স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
পাচার প্রতিরোধে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ও ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ সেল গঠন করা প্রয়োজন। যেসব দেশে নারী-শিশু পাচার হয় সেসব দেশের সঙ্গে নারীশিশুদের ফিরিয়ে আনা ও চুক্তির ব্যবস্থা করাসহ, আদালতে পাচারকারীদের জামিন অযোগ্য আইন করা, পাঠ্যপুস্তকে পাচারের ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করা, পাচারকারীর বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি পাচারের ভয়াবহতা সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমে বেশি করে প্রচার করাসহ, প্রতিটি থানায় ও বর্ডার চেকপোস্টে পাচারকারীদের ছবি প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নারী ও শিশু পাচারের সম্ভাব্য কৌশলগুলো বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি নারী ও শিশু পাচার ও নির্যাতন বিষয়ে বেশি করে কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করাসহ পাচার প্রতিরোধের কাজে সংশ্লিষ্টদের সবাইকে সম্পৃক্ত করে তাদের কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।
মানব পাচার আধুনিক সভ্যতার নিকৃষ্টতম জঘন্য অপরাধ। সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই মানব পাচার, বিশেষ করে নারী ও শিশু পাচাররোধে সফলতা বয়ে আনবে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও সম্পর্কে সম্মানের চর্চা থাকলে নিশ্চয়ই পাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ বন্ধ হবে। মানুষের প্রতি মানুষের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও মানবতাবোধ জাগ্রত হোক, জয় হোক মানবতার-এই হোক আমাদের অঙ্গীকার ও প্রত্যয়। (পিআইডি ফিচার)
সহকারী তথ্য অফিসার, পিআইডি, ঢাকা
