Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস

সব প্রতিকূলতা জয় করার মূলে রয়েছে সহিষ্ণুতা

Icon

খন রঞ্জন রায়

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সব নাগরিকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা উন্নত করার অপরিহার্য নীতি আদর্শ নিয়ে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস পালনের আকাঙ্ক্ষা জানানোর প্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪৮/১২৬ নম্বর সিদ্ধান্তের আলোকে ১৯৯৫ সালে প্রথম সহিষ্ণুতা বর্ষ পালন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক সম্পর্ক সংরক্ষণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা দৃঢ় করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনে প্রতি বছর ১৬ নভেম্বর আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস (International day of Tolerance) পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

আগামী প্রজন্মকে যুদ্ধের অভিশাপ হতে রক্ষা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, মানবিক মূল্যবোধ ও আইনের বাধ্যবাধকতার প্রতি সম্মান ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠাই এ দিবসের লক্ষ্য। সমাজের স্বাভাবিক সুস্থতার চেয়ে মহত্ত্বর আর কোনো কিছু নেই। জীবনের সর্বস্তরেই সহিষ্ণুতার মূল্য অপরিসীম। এ শব্দটি মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। শক্তিধর এ গুণটি মানুষের জীবনকে নানাভাবে অর্থময়-রসঘন করেছে। ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু ব্যক্তিই জীবনকে সার্থক করে উর্বর করে তোলে। জীবন চলার পথে সংঘাত, দুঃখ-দৈন্য, বিপদ-আপদ মানুষের নিত্যসঙ্গী। মানুষের চিত্ত কখনো আলোড়িত হয়; কখনো বা চঞ্চল, সংক্ষুব্ধ হয়। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, অভিমানে, বিশুদ্ধ সৌন্দর্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কখনো বা কান্নামেশানো দীর্ঘশ্বাসে চিত্ত ব্যাকুল হয়। ইতিহাসের কঠিন আঘাতের কথা ভেবেই কালের দাবি, কালান্তরের উপযোগিতা হিসাবে সহিষ্ণুতা পরমবন্ধু হয়। যে ব্যক্তি ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অসন্তোষের মধ্যেও শান্ত-চিত্ত, ধৈর্যশীল থাকতে পারে, তিনিই জীবনযুদ্ধ জয়ের অধিকার রাখেন। সহিষ্ণু ব্যক্তি অবিচলিত থাকেন বলেই পরম সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাসের অংশ হতে পারেন।

ব্যক্তি-পরিবার-রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্টের অন্যতম কারণ অসহিষ্ণুতার প্রশ্রয়। সহিষ্ণুতা গার্হস্থ্য জীবনেও আনে সুন্দরের স্বপ্ন। পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-পরিজন, সমাজের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্প্রীতির সম্পর্ক। পরিবারের বৃহত্তর রূপ রাষ্ট্র সমকালীন গুরুত্বে, নানা আঙ্গিকের নতুনত্বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সহিষ্ণুতার ভূমিকা ব্যক্তি থেকেই উৎসারিত হয়। মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে, দেশে-দেশে সুসম্পর্ক তৈরি করে মানুষের ব্যক্তিগত আচরণের সহনশীলতা। মানুষের আচরণ সৃজনশীলতার এক পরম উপাদেয় সামগ্রী। মানুষের মনের সামর্থ্য ও সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় পরমতসহিষ্ণুতা। হৃদয়ের কৃতজ্ঞতাই সহিষ্ণুতা। মানুষের মগ্ন চৈতন্য থেকে উৎসারিত সৃজনশীল উপাদানে সৃষ্টি হয় সহিষ্ণুতা। সহিষ্ণুতা আচরণের কোনো লিখিত রূপ নেই, ইতিহাস নেই। সাহিত্যের যেমন ইতিহাস আছে, দর্শন-বিজ্ঞানের ইতিহাস আছে, সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাস আছে, আছে যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস; কিন্তু নেই মানুষের আচরণগত সহিষ্ণুতার ইতিহাস। চরিত্র অনুশীলন সাপেক্ষে সৃজনের বেদনা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পর উপলব্ধি করা যায় মাত্র।

মানবসভ্যতার সেই শুরু থেকে যে সংগ্রামনির্ভর চলমান জীবন, তাতে জয়ী হয়েছে সাহসী ও সহনশীল ব্যক্তিরা। শান্ত চিত্তে প্রতিভার বিচারবলে সব প্রতিকূলতা জয় করার মূলে রয়েছে সহিষ্ণুতা। অন্যসব মানবিক গুণাবলির মতো সযত্নে লালন, পরিচর্যা, অনুশীলনই সহিষ্ণু চরিত্রের বিকাশ ঘটায়। এতে চিত্তদ্বার রুদ্ধ থাকে না; বিপুল ঔদার্যের অধিকারী হয়। জীবনের বিচিত্র কর্মকাণ্ডের সতত চঞ্চল পরিক্রমায় ঈর্ষা কিংবা ক্ষোভের জন্ম না হয়ে হয় আনন্দিত। বলা হয়ে থাকে, সৃজনশীল সহনশীল-সহিষ্ণু মানুষের আচরণ হয় আকর্ষণীয় ও প্রভাবশালী। জগতের সব সহিষ্ণু মানুষই মানবতা গুণে দীপ্ত। ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু ব্যক্তিরাই মানবজন্মকে সার্থক করে তোলেন। অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে তারা এগিয়ে যান অবিচল নিষ্ঠায়। যতই ঝড়-কালবৈশাখী আসুক, রক্তচক্ষু লাঞ্ছনা সহ্য করে নির্ভিক থেকে তারা অমৃতের প্রাণ হয়েছেন। দীপ্তপ্রাণ হাস্যোজ্জ্বল থেকে সুখের স্বর্ণ সিংহাসন থেকে নেমে এসেছেন পথের ধুলায়।

অসহিষ্ণুতা কেবল ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করে না; পরিবেশ প্রকৃতিকেও অদলবদল-রদবদল করে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঝড়, খরা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, উচ্চ তাপমাত্রা, বন্যা প্রভৃতির তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শস্যের গুণাগুণ নষ্ট হয়। উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়। পরিবর্তন হচ্ছে চাষাবাদ পদ্ধতি। মাটির উর্বরতা, পানির স্বল্পতা, ফসলের রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। বিচিত্র ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করছে জীবিকার তাগিদে অপরিহার্য কৃষিতে কাজ করা লোকজন। যে কৃষক কৃষিতে কীটনাশকের দিকে সহজে ঘেঁষত না, সেই কৃষকই উচ্চফলনের তাগিদে কীটনাশক ও কৃত্রিম সারের প্রয়োগ বাড়াচ্ছে। প্রকৃতির আদিরূপে, অহংকারবোধে মন কেড়ে নেওয়া স্বাস্থ্যকর কৃষি উৎপাদন সমাজে বিরল হয়ে উঠছে। সেচের ব্যাপকতা, রাসায়নিকের অবাধ ব্যবহার পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ভূমিক্ষয়, মৎস্য বৈচিত্র্য দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। কৃষকের আন্তরিক হাসি এখন প্রায় উধাও।

কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ ‘বাংলাদেশ’ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর আকস্মিক বন্যায় ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। সমাজে এখন মানুষের শিক্ষা, মানুষের বিদ্যাবুদ্ধি, মানুষের জ্ঞানের বিস্তার, অকল্পনীয়ভাবে বেড়ে গেছে; কিন্তু সংকীর্ণ হয়েছে ব্যক্তির ধৈর্য। মনের মাধুর্য, চরিত্রের নম্রতা, ধৈর্যের সঙ্গে সাহস, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতার যোগনিষ্ঠতা এখন উধাও। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা চিত্তের উদারতা গ্রহণ করার শক্তি হারিয়ে ফেলি। সদাহাস্য, প্রাণবান, সতেজ জীবনরসের রসিক মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। সেখানে জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি উপকরণ ব্যবহার এবং নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা আমাদের আশার আলো দেখায়। খরা, তাপ, লবণাক্ত সহিষ্ণু কৃষিজাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। শস্য বহুমুখীকরণ প্রযুক্তির সঙ্গে সংযোগ ঘটানো হচ্ছে। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পানির সামাজিক ব্যবস্থাপনা, খামারে পানি ব্যবস্থাপনা, প্রচলিত কর্ষণ পদ্ধতি, ভূমি ব্যবহার পদ্ধতি, জ্বালানি সাশ্রয়ী কৃষিযন্ত্রপাতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আন্তঃফসলের উপযোগিতায় চাষ পদ্ধতির বৈচিত্র্যায়নের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশসহিষ্ণু চাষাবাদ পদ্ধতি সংযুক্ত করা হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে কৃষিবিজ্ঞানীদের জলবায়ু সহিষ্ণু জাতের শস্য উদ্ভাবনে প্রভূত প্রণোদনা, নির্দেশনা, পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকট দেখা দেবে। সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধিতে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা উপকরণ দুষ্প্রাপ্য হবে। জীবিকার উৎস ধ্বংস হবে। শ্বাসকষ্ট, হিটস্ট্রোক কিংবা ঠাণ্ডাজনিত মৃত্যু প্রকোপ বেড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে প্রান্তিক মানুষ। সমুদ্র, নদী, হাওড়, খাল-বিলের পানিপ্রবাহ পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদ নষ্ট হচ্ছে। আমিষ ঘাটতির কারণে মানুষ অপুষ্টির শিকার হচ্ছে।

ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ে বিভেদের পরিবর্তে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহনশীলতা সৃষ্টি করা সহিষ্ণুতার মৌল ভিত্তি। সমাজে নানামুখী অসংগতি, অন্যায়, অনিয়ম, মানবিক মূল্যবোধের অভাব, অসহিষ্ণুতা ও স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের মৌলিক নীতিই হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। মানবজীবনে এ দুর্লভ সম্পদের অধিকারী হই, অসুন্দরের সব নগ্নতা পরিহার করি-আজকের দিনে এটাই প্রণতি।

সমাজকর্মী

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম