ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে আমাদের করণীয় কী?
শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ৭.৮ মাত্রার ঘটে যাওয়া এ মহা-প্রলয়ংকরি ভূমিকম্পে পৃথিবী এখন নড়েচড়ে বসেছে। বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি কাড়ার পাশাপাশি খানিকটা উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে সবাইকে। ১৯১২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগনার ‘টেক্টোনিক প্লেট’ সম্পর্কে ধারণা দেন। তার এ তত্ত্বের নাম দেওয়া হয় ‘কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট’। ভূগর্ভস্থ টেক্টোনিক প্লেটের ঘর্ষণের ফলে ভূমি সাময়িকভাবে কেঁপে ওঠে, এটাই ভূমিকম্প। আমি যদি আর একটু সহজ করে বলি-ভূমিকম্প হচ্ছে মূলত ভূ-অভ্যন্তরে যখন একটি শিলা অন্য একটি শিলার ওপরে উঠে আসে, তখন ভূমিকম্পন হয়। এটি অনুভূত হওয়ার সহজ উপায় হচ্ছে, ঝুলন্ত বস্তু যেমন-দেওয়ালঘড়ি, টাঙানো ছবি বা অন্যান্য আসবাবপত্র হঠাৎ যদি দুলতে শুরু করে, তখন বুঝতে হবে ভূমিকম্প হচ্ছে। আলফ্রেড ওয়েগনারের তত্ত্বটি আরও একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভূগর্ভে চলমান বিভিন্ন বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন নানা গ্যাস টেক্টোনিক প্লেটগুলোর ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। এ চাপের তারতম্যও ভূমিকম্পের জন্য খানিকটা দায়ী। সাধারণত টেক্টোনিক প্লেটের মাঝামাঝি ভূপৃষ্ঠের যেসব স্থান আছে, সেখানে ভূমিকম্পের তীব্রতা তেমন একটা অনুভূত হয় না। কিন্তু যেসব স্থান দুই বা ততোধিক প্লেটের সংযোগস্থল বা ফল্ট লাইনে অবস্থিত, সেখানে ভূমিকম্পের তীব্রতা ও ভয়াবহতা অনেক বেশি হয়। কারণ ভূকম্পনের উৎপত্তি ঠিক এ ফল্ট লাইন থেকেই শুরু হয়। বেশকিছু গবেষণায় উঠে আসছে, পৃথিবীতে বছরে গড়ে ছয় হাজার ভূমিকম্প হয়। তবে এগুলোর বেশির ভাগই মৃদু বলে আমরা টের পাই না। সাধারণত কম্পনের ওপর ভিত্তি করে তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে-প্রচণ্ড, মাঝারি ও মৃদু। অন্যদিকে উৎসের গভীরতা অনুসারে ভূমিকম্পকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়-অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? মানচিত্র লক্ষ করলে দেখা যায়-ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ুর প্রভাব, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অসংখ্য নদ-নদীর গতিপ্রবাহ, ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে প্রায় সময় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে থাকে। অন্যদিকে উত্তরে তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থল বা ফল্ট লাইনে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় ভূমিকম্পের ঝুঁকিও তুলনামূলক বেশি। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দুই যুগের যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, ‘ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো ভূমিকম্পের শক্তি বের হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হয়ে রয়েছে। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্বদিকে বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে!’ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া যেহেতু খুব জটিল বিষয়, তাই কখন-কেমন ভূমিকম্প হতে পারে, তা নির্দিষ্ট করে বলা স্বভাবতই অসম্ভব! তবে গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাব্য পূর্বাভাস ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থান নির্ণয় করা যায়। তাই এ বিষয়ে আমাদের সম্যক জ্ঞান রাখা ও সচেতন হওয়া খুবই দরকার।
এ ভয়ংকর দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় কী হতে পারে? দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের অনেক ফ্রেমওয়ার্ক আছে। যেমন-ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-২০১২, এসওডি, ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০১৫ ইত্যাদি। ভূমিকম্পের সময় ভবন ধসে যেহেতু ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির পরিমাণ অনেক বেশি হয়, সেহেতু ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড যথাযথ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, যথাযথ আর্কিটেকচারাল, স্ট্রাকচারাল ইলেকট্রোমেকানিক্যাল ও প্লাম্বিং ডিজাইন বা ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া শুধু মিস্ত্রি দিয়ে বিল্ডিং বানানো হয়। ফলে মিস্ত্রি তার অজ্ঞতার কারণে কোথাও ম্যাটেরিয়াল কম দিলে, তা ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া ভূমিকম্প হচ্ছে টের পেলে দ্রুত ফাঁকা ও উন্মুক্ত স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। উঁচু ভবনে থাকলে এবং বের হতে না পারলে জানালা বা দেওয়ালের পাশে অবস্থান না নিয়ে শক্ত কোনো বিম, টেবিল বা শক্ত কোনো কিছুর নিচে অবস্থান করা যায়। সম্ভব হলে মাথার ওপর শক্ত করে বালিশ অথবা অন্য কোনো শক্ত বস্তু যেমন- কাঠবোর্ড, নরম কাপড় চোপড়ের কুণ্ডলী ইত্যাদি ধরে রাখুন। গ্যাস এবং বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে দূরে অবস্থান করা দরকার। উঁচু ভবন থেকে দ্রুত নামার জন্য একদমই লিফট ব্যবহার করা যাবে না। শুধু ভূমিকম্পের সময় নয়, মোবাইল ফোনে ফায়ার সাভির্স এবং দরকারি মোবাইল নম্বরগুলো সব সময় রাখা উচিত। বিপদের সময় এগুলো বেশ সহায়ক হয়।
আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-যেটি নিয়ে আমরা খুব একটা সচেতন নই, তা হলো ভূমিকম্প শেষ হওয়ার পরও একটি-দুটি বা ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়ে বেশি মৃদু কম্পনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়, যেটিকে ‘আফটার শক’ বলে। সিরিয়া-তুরস্কে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের পর প্রায় অর্ধশতাধিক পরাঘাত (বড় ভূমিকম্পের পর ছোট ছোট ভূমিকম্প) হয়েছে। তাই প্রথম পর্যায়ের ভূমিকম্পের পর অন্তত ঘণ্টা দুয়েক নিরাপদ স্থানে থাকা বাঞ্ছনীয়। এছাড়া প্রকৃতিকে পিষে আমরা যেভাবে শিল্পায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, তা কখনোই কাম্য নয়। ইতোমধ্যে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করছে। তাই প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ করা থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
শিক্ষার্থী, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
