দায়িত্বে অবহেলার মহামারি ও বঙ্গদেশের আগুন
তৌহিদ বিল্লাহ
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সকাল বেলার ধনী রে তুই, ফকির সন্ধ্যা বেলা-জাতীয় কবির এই পঙ্ক্তির সঙ্গে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের স্বপ্নভঙ্গ আর কপাল পুড়ে নিঃস্ব হওয়ার দৃশ্য যেন সমান্তরাল অর্থই বহন করে। বঙ্গবাজারের কয়েকশ ব্যবসায়ী একটি রাতের ব্যবধানে সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন। ঈদের আগে সংঘটিত এই অগ্নিকাণ্ডকে অনেকেই ‘রহস্যজনক’ মনে করছেন। কোনো মহল বলছেন, এটি পরিকল্পিত নাশকতা; আবার কারও দাবি নিছক দুর্ঘটনা। ঠিক কী কারণে এ ঘটনা ঘটল, তা বুঝতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। প্রশ্ন হলো, এ তদন্তে কি বেরিয়ে আসবে প্রকৃত কারণ? সেটা না হয় তদন্তের পরই জানা যাবে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনা সংক্রান্ত কার্যক্রমের ২০২২ ও ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে এ দুবছরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৬৩টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আগের ১৪ মাস ১০ দিনে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে ১৪৫ জন। ২০২২ সালে সারা দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৩৪২ কোটি টাকার বেশি সম্পদ পুড়েছে। এর আগের বছর ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকাণ্ডে ২১৮ কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে যায়। আর ২০২০ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ৭৩টি আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৪৬ কোটি টাকা। সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে, একটা ঘটনা সংঘটিত হলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যদি সুষ্ঠু বিচার হতো, তাহলে পরে এ ধরনের অপরাধ বা দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট অবহেলা হ্রাস পেত বহুলাংশে।
আমরা বাংলাদেশে গত দেড় দশকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যদি দেখি-২০০৯ সালে বসুন্ধরা সিটি থেকে ২০১০ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডি, ২০১২ সালে তাজরিন ফ্যাশনের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড থেকে মহাখালীর কড়াইল বস্তি। ডিএনসিসি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ড থেকে ২০১৯ সালে ঘটে যাওয়া চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহতম অগ্নিকাণ্ড। তারপর বনানীর আর এফ টাওয়ারের রেশ কাটতে না কাটতেই নারায়ণগঞ্জের সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এই একই সময়ের মধ্যে নানা দুর্ঘটনার আবর্তে ভবনধস, একাধিক উল্লেখযোগ্য সড়ক দুর্ঘটনা, আছে নৌকা কিংবা জাহাজডুবির ঘটনা অথবা আছে পাহাড়ধসের সংবাদ; দুর্ঘটনার এ তালিকায় আছে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হওয়ার ঘটনাও। এভাবে মানুষের প্রাণনাশের ঘটনা এ দেশে যেন বছরব্যাপী একটি চলমান প্রক্রিয়া! দুর্ঘটনার এ ধারাবাহিকতা যেন এ দেশের কপালের লিখন! তবে দুঃখজনক ও তিক্ত সত্য হলো, এমন একটি ঘটনাও পাওয়া যাবে না, যার জন্য প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনকারীদের অবহেলার প্রমাণ মেলেনি। ঘটনা ঘটলে তদন্ত হয়, আর তদন্তে বেরিয়ে আসে সেই একটি কথাই ‘দায়িত্বে অবহেলা’। কখনো কখনো তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখতেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় এ দায়িত্বে অবহেলাই! আসলে বাংলাদেশে যত দুর্ঘটনাই ঘটে, তার জন্য এই ‘দায়িত্বে অবহেলা’ নামক রোগ থেকেই সব দুর্ঘটনার সূত্রপাত। দিনে দিনে এ রোগ যেন বাংলাদেশে মহামারি তথা মহারোগে পরিণত হচ্ছে!
এই তো মাসখানেক আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের এক ভয়াবহ দৃশ্যেও মিলল দায়িত্ব অবহেলার স্পষ্ট ছাপ। ঘটনা-দুর্ঘটনার ধারাবাহিকতায় বঙ্গবাজার যেন নিয়মিত দুর্ঘটনার সর্বশেষ সংযোজন মাত্র! তারপর কোথায় অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা ঘটবে, সেটাও হয়তো কিছু সময়ের অপেক্ষামাত্র! সময়ের নিয়ম মেনে দেশে দুর্ঘটনার এ ধারাবাহিকতার দৃশ্য অনুযায়ী প্রশ্ন তো জাগতেই পারে, বঙ্গদেশের আগুনকে এখন বঙ্গবাজারের আগুন বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে না তো? কারণ, যে দেশে আগুনের ঘটনা নিয়মিতই ঘটে, সেখানে বঙ্গবাজারের আগুন তো বাংলাদেশে নিয়মিত দুর্ঘটনার প্রতিচ্ছবি মাত্র। সুতরাং এ ঘটনাকে বঙ্গবাজারের আগুন না বলে বঙ্গদেশের আগুন বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত নয় কি?
আচ্ছা বলুন তো, পৃথিবীর কোনো দেশে কি বাংলাদেশের মতো ঠিক এভাবেই একটার পর একটা সিরিয়াল ধরেই দুর্ঘটনা ঘটে? আবার মনে প্রশ্ন জাগে, এগুলো সবই আসলে দুর্ঘটনাই তো! জনমনে প্রশ্নটা জাগবেই না কেন? বাংলাদেশে কোনো ঘটনা ঘটলেই সেটা নিয়ে যতটুকু রাজনীতি শুরু হয়, তার বিপরীতে বিচারটা কি সেই অনুপাতে হয়? এসব দেখে জনমনে প্রশ্ন উঠা কি খুবই অস্বাভাবিক? ২০১৩ সালের এপ্রিলের ২৪ তারিখে সাভার বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন রানা প্লাজার কথা এ দেশের মানুষ একশ বছর পরও হয়তো ভুলতে পারবে না। ওই ঘটনায় ১ হাজার ১৩৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়। সে ঘটনা নিয়েও এ দেশে সরকারি ও বিরোধীদের পরস্পর দোষারোপের দৃশ্য দেখেছিল এ দেশের মানুষ। বিরোধীদলকে দায়ী করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি মন্তব্য নিয়ে দেশে কত তুলকালামের রাজনীতি হয়েছিল। কিন্তু সেই রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা কিংবা যাদের পাহাড়সম দায়িত্বে অবহেলাজনিত কারণে হাজারেরও বেশি মানুষ নির্মমতার বলি হলেন, তার বিচার হয়েছে কি? যা হোক, আমরা না হয় রাজনীতির হিসাব বাদ দিলাম। আমরা ধরেই নিলাম সব বিপর্যয়, সবই নিছক দুর্ঘটনা। তাহলে তো আবারও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে-দশকের পর দশক ধরে অব্যাহত এসব দুর্ঘটনা রোধের কোনো সুপরিকল্পিত সমাধান কি এ দেশে অধরাই থেকে যাবে? অব্যবস্থাপনার বিপরীতে সুব্যবস্থা আর সুরক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থাটা কোথায়? এই যে দেশে এত এত উন্নয়নের ফিরিস্তি গাওয়া হয়, তার সুফলটা কোথায়? উন্নয়নের প্রবাহে এত এত সুউচ্চ অবকাঠামো নির্মিত হলো ঠিকই; কিন্তু মানুষের জান-মালের সুরক্ষার জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত? এসব ঘটনা-দুর্ঘটনা কিংবা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যে সরকারের উন্নয়নকেও জনগণের কাছে পুড়ে ছাই করে দেয়, তা কি সরকার কর্তৃক নিয়োজিত দায়িত্বে থাকা দায়িত্বশীলরা অনুধাবন করেন? তাই বলব, জনগণের জান-মালের সুরক্ষাই হোক উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ। তারপর সুরক্ষিত জনপদে আসতে পারে উন্নয়নের প্রশ্ন।
আমার একটা জিনিস বুঝে আসে না, বাংলাদেশে প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই কেন অবকাঠামোগত ত্রুটিগুলো চোখে পড়ে? দুর্ঘটনার আগে কেন কর্তৃপক্ষ সমস্যা শনাক্ত করতে পারে না? কোনো একটা দুর্ঘটনার শেষ যেখানে, আমাদের কর্তৃপক্ষের শুরুটা যেন সেখান থেকেই! জীবন-সম্পদ সব ভস্মীভূত হওয়ার আগে কোনো কিছু তাদের চোখে পড়ে না কেন? কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই অবকাঠামোগত ত্রুটির কথা বলে দায় সেরে ফেলার একটা প্রবণতা এ দেশে প্রকট। একটি বাস কিংবা ট্রাক দুর্ঘটনার শিকার হলে বের হয় গাড়িটি আনফিট ছিল; অথচ দুর্ঘটনার আগে কিন্তু ‘আনফিট’ বলে গাড়িটিকে শনাক্ত করেনি কেউ! এ দেশে এ সবই যেন নিয়ম! কিছুদিন আগেই তো গুলিস্তানে বিস্ফোরণের পর ভবন নির্মাণের ত্রুটি শনাক্ত করা হলো। দুর্ঘটনা না ঘটলে আজও কর্তৃপক্ষ এ ভবনের তদারকি করত কিনা সন্দেহ। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ডিজি বললেন-বঙ্গ বাজারের এসব মার্কেটকে ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল থেকে ১০ বার নোটিশ দেওয়া হয়েছে, ভবনে ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু নোটিশ দেওয়ার পরই কি দায়িত্ব শেষ? উনাদের বা সরকারের প্রশাসনের আর কিছুই করার ছিল না? একটা নোটিশ দশবার টাঙিয়ে দেওয়াই কি এ দেশে সুরক্ষা ব্যবস্থার শেষ সীমা? এভাবে জনকল্যাণের উন্নতির তুলনায় ‘দায়িত্বে অবহেলার’ জ্যামিতিক অনুপাতটা মারাত্মক আকার ধারণ করলে দেশটা অব্যবস্থাপনার অতল গহবরের পথেই হাঁটবে, সন্দেহ নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় এ দেশটা অগ্নিকাণ্ড, ভবনধস, নৌকাডুবি আর বিস্ফোরণের জন্য কবে না জানি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়ে বসে! দায়িত্বে অবহেলায় বাংলাদেশ পুড়ে অঙ্গার হয়, আবার এ দায়িত্বে অবহেলার কারণেই বাংলাদেশ ডোবে নদীতে, এ একই কারণে ধসে পড়ে কিংবা বিস্ফোরিত হয় বাংলাদেশ! এত কিছুর পরও দেশে ‘দায়িত্বে অবহেলাকে’ কেন আজও পেলেপুষে বড় করা হচ্ছে? এ দায়িত্ব অবহেলাকে কি কোনোদিনও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে না?
ডাঙ্গা, পলাশ, নরসিংদী
tawhidbillah30086@gmail.com
