|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সুখ-শান্তি জিনিসটা আপেক্ষিক। শব্দ দুটি একান্তই মনের ব্যাপার এবং অনুভবের বিষয় বলে মনে হয়। সুসাহিত্যিক কথাশিল্পী শওকত ওসমান রচিত ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসটি পাঠ করলে এ বিষয়টি আরও বেশি পরিষ্কার হয়। এ দুটি শব্দের সংজ্ঞাও সবার কাছে এক নয়। কেউ মনোরম অট্টালিকায় সুন্দর বিছানায় ঘুমিয়েও অসুখী; আবার কেউ সাধারণ ঘরে থেকেও সুখী। বাইরের ঐশ্বর্য- যা দেখা যায়, আমরা সেটা দেখে কোনো মানুষকে চিহ্নিত করি সুখী অথবা দুঃখী হিসেবে। কিন্তু এভাবে সুখী বা দুঃখী হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করা এত সহজ নয়।
আমার মনে পড়ছে, ছোটবেলায় প্রাথমিকে পাঠ্য হিসেবে পড়া ‘সুখী মানুষ’ গল্পটির কথা। এখন আর গল্পটি পাঠ্যবইয়ে নেই। তবে যারা গল্পটি পড়েছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। সুখের জন্য আমরা সৎ-অসৎ বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন কাজ করে থাকি। অর্থ উপার্জনে অনেকেই আমরা বৈধ-অবৈধ সব পথ অবলম্বন করি। অর্থের মধ্যে আমরা সুখ তালাশ করি। আর ধনবান হলে মনে করি, সুখী হয়েছি কিংবা সুখের অভিনয় করি। আমরা অনেকেই নিজ নিজ অবস্থানে অসুখী কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা সুখের অভিনয় করে থাকি। আমরা হয় নিজের সুখের জন্য অথবা পরের সুখের জন্য অর্থ উপার্জন করে থাকি। যদিও আমরা জানি না- উপার্জিত অর্থ ভোগ করতে পারব কিনা!
তবে অর্থই অনর্থের কারণ হতে পারে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন তার কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’তে বলেছেন- অর্থই অনর্থের মূল। অর্থ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না সত্য, কিন্তু অতিরিক্ত অর্থও মানুষকে দুশ্চিন্তা ও অশান্তিতে ফেলে দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে মুচির গল্পটি স্মরণ করা যেতে পারে। অবশ্য একইসঙ্গে আমি ভুলে যাচ্ছি না- মধ্যযুগের সেরা কবি ও নাট্যকার শেকসপিয়রের কথা। তিনি বলেছেন- অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।
অভাবে ভালোবাসা পালায় সত্য, তবে স্বভাবেও পালাতে পারে। অতিরিক্ত আশা এবং লোভ কি আমাদের আচরণে প্রভাব ফেলে না? অর্থ মানুষকে মানুষের পর্যায় থেকে পশুর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। অর্থের অভাবে যেমন সম্পর্ক ও সংসার ভাঙতে পারে, তেমনি অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়েও এসব ভাঙতে বা নষ্ট হতে পারে। আমরা এখন প্রায়ই লক্ষ করছি- স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করার কারণে বিবাহিত ব্যাচেলর হিসেবে বসবাস করছে। পরিসংখ্যান আমাদের এটাও বলছে যে, আধুনিক সমাজে যেমন বাড়ছে একক পরিবার ও অনু পরিবার, তেমনি বাড়ছে একক মাতা, একক পিতা পরিবার (ঝরহমষব ভধঃযবৎ ্ ংরহমষব সড়ঃযবৎ ভধসরষু)। আমরা এখন অনেকেই পরিবার ও সমাজকে গুরুত্ব দিচ্ছি না; অথচ শিশুকে মানুষরূপে গড়ে তোলার কাজটি পরিবার ও সমাজই করে থাকে। এক্ষেত্রে ক’জন আমরা ভবিষ্যতের শিশুদের কথা ভাবছি- যারা কিনা ভবিষ্যৎ কর্ণধার। আমরা ভাবছি অর্থনৈতিক উন্নতির কথা।
মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই সবকিছু নয়। অর্থের অভাবে কোনো মানুষ যুদ্ধ করেছে বলে জানা নেই, তবে অর্থ আর ক্ষমতার লোভ মানুষকে যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করেছে যুগে যুগে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় বলেছেন- এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে- যার ধন আছে, ধনের প্রতি লোভটা তারই বেশি। কিন্তু মানুষের থাকতে হয় কিছু মানবিক গুণাবলী; নয় তো সে মানুষ থাকে না। একেকজন মানুষের বৈশিষ্ট্য একেকরকম হওয়ায় সবার জন্য সাধারণ প্রেসক্রিপশন (ব্যবস্থাপত্র) দেয়া কঠিন। এ জগতে জটিল ও কঠিন যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সেটা মানুষের মন ব্যতীত আর কিছু নয়।
এ দুনিয়াতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অর্থের জন্য নয়, বরং এ ক্ষেত্রে অর্থের একটি ভূমিকা রয়েছে বলা যায়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আত্মার, অর্থের নয়। যারা শুধু অর্থ দিয়ে সম্পর্ক বিচার করে, তাদেরকে আমার কিছু বলার নেই। সবশেষে একটি কথা বলতে চাই- সুখী হওয়ার জন্য খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন শুধু একটি পরিতৃপ্ত মন।
সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জামালপুর
