নদীর শুষ্কতায় হারিয়ে যাচ্ছে মাছ
নূরজাহান নীরা
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নদীমাতৃক দেশ আমাদের এ বাংলাদেশ। নদীবিধৌত উর্বর পলিমাটির কারণে যেমন আমাদের দেশ সুজলা-সুফলা, তেমনি ইতিহাস-ঐতিহ্যে আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মাছ এবং ভাত খাদ্য হিসাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভাত যেমন আমাদের প্রধান খাবার, তেমন মাছ প্রধানত আমাদের আমিষের চাহিদা পূরণ করে থাকে। এ ঐতিহ্যকে এদেশের মানুষ মনেপ্রাণে লালন করে। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ কথাটা বলেও যেন তৃপ্তি মিলে। যদিও আগের মতো মাছের দেখা মিলে না। এখন যার টাকা আছে, সে কিনে খেতে পারে, যার টাকা নেই, সে কিনে খেতে পারে না। বাজারের অধিকাংশ মাছই চাষের মাছ। নদ-নদীর দেশীয় মাছ যা পাওয়া যায়, তা চড়া দামে কিনতে হয়। এ চড়া দামের কারণে মাছে-ভাতে বাঙালি, কথাটার সঙ্গে বর্তমান সময়টা বিপরীতমুখী হতে বসেছে। অথচ একটা সময় এ মাছের জোগান আসত বাংলাদেশের নদী-নালা, খাল-বিল থেকে। বর্ষাকাল শুরু হতেই নতুন নতুন সব মাছের দেখা মিলত আর শীতকাল পর্যন্ত পাওয়া যেত সেসব মাছ। শীতের শুষ্কতায় নদী-নালা, খাল-বিলের পানি কমে এলে প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়ত মাছ। এ সময়ে মাছ সংগ্রহ করে তা শুকিয়ে শুঁটকি করে রাখা হতো। আউস ধানের ক্ষেতে ধান কাটার পর ধরা হতো টাকি, কই, পুঁটি, মায়াসহ আরও অনেক মাছ। এ দেশের মানুষ তখন মাছ উৎপাদনের জায়গা বলতে প্রাকৃতিক এ জলাশয়গুলোকেই বুঝত। গ্রামে গ্রামে ছিল জেলেদের বাস। জেলেরা এসব প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নদীপাড়ের মানুষগুলোর জীবন ও জীবিকা এ নদীর ওপর নির্ভর করত। কালের বিবর্তনে আমাদের সেসব নদী বা অন্যান্য জলাশয় হারিয়ে যেতে বসেছে, হারিয়েও গেছে অনেক। ভরাট হয়ে গেছে সেসব জলাশয়। নদীগুলো চলে গেছে দখলদারদের কবলে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে শুকিয়ে গেছে। যে জলাশয়ে সারা বছর মাছে ভরপুর থাকত, তা আজ গোচারণ ভূমি। এ অবস্থা সারা বাংলাদেশেই। যদি বাংলাদেশের এ নদী-নালা, খাল-বিলগুলো খনন করে আবার আগের মতো করা যেত, তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও ফিরে আসত সেই হারানো ঐতিহ্য। বর্তমান প্রজন্ম মাছ বলতে শুধু চাষের মাছকেই চিনে। অল্প আয়ের মানুষ পাঙাশ আর সিলভারকার্প ছাড়া অন্য মাছ কিনতেও পারে না তেমন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আমাদের জমি কমে আসছে, বাড়ছে চাহিদা। সে চাহিদা পূরণের জন্য প্রযুক্তিগতভাবে অল্প জায়গায় বেশি মাছ চাষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এতে চাহিদার পাশাপাশি বেকার সমস্যাও দূর হচ্ছে। ২০০৭ সালের দিকেও বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যায় ইলিশ আর চাপিলা মাছে জেলেদের জাল ভরে যেত। একদিন মাছ ধরলে একটি পরিবারের পনেরো দিন চলে যেত। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তা আজ শুধুই ইতিহাস। এ গরিব মানুষগুলোর কাছে মাছ যেন আজ কল্পনার কোনো অধরা বস্তু। কলকারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল, সার, লবণ, রঙের পানি, পয়ঃনিষ্কাশনসহ বিভিন্ন আবর্জনার স্তূপ এখন এ প্রবহমান উচ্ছল নদীগুলোয়; যা একসময় ছিল মাছের অভয়ারণ্য। যদি খনন করা হয় নদী-খালগুলো। একটু সচেতন আর আন্তরিক হলে তা সম্ভব। নিয়ম করে যদি কলকারখানার বর্জ্য ও পানি শোধনের মাধ্যমে তা নদীতে ফেলা হয়, নদী দখলমুক্ত করা হয়, এলাকার জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে খাল, হাওড়-বাঁওড় চিহ্নিত করে খনন করা হয়, তাহলে সেই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতা। যেসব জলাশয় ভরাট হয়েছে, তা আবার জেগে উঠুক, নদীগুলো প্রাণ ফিরে পাক, এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। সবার কথায় যুক্ত হোক ‘দেশ বাঁচাতে চাও যদি, সবার আগে বাঁচাও নদী।’
চিকিৎসক ও লেখক
