বসন্তের প্রকৃতি
মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বসন্তের রূপময় নিসর্গ ছুঁয়েছে বাংলার অলিগলিতে। ফুলের মহিরুহ সাজে সেজেছে বাংলার প্রকৃতি। কী অপরূপ, কী মায়াবী বাহারি ফুলের ছড়াছড়ি! কোকিলের কুহুতানে মুখরিত হয় গ্রাম পাড়ি দিয়ে শহরের পথঘাট। বসন্তের সবুজ-শ্যামল নয়ন কাড়া দৃশ্যপট নাড়া দেবে মনের মাঝে। শীতের মায়া ছিঁড়ে এসেছে ঋতুরাজ। শুকনো পাতারা ঝরে গিয়ে জন্ম নেবে কচি নতুন পাতা। সেই পত্র-পল্লবে, ঘাসে ঘাসে, নদীর কিনারে, কুঞ্জ-বীথিকা আর ওই পাহাড়ে অরণ্যে বসন্ত আজ দেবে নবযৌবনের ডাক।
মহান রবের মহান সৃষ্টির অবলোকনে আলোকময় প্রতিজন। কতটা নিবিড়ভাবে সাজিয়েছেন প্রকৃতির আয়োজন। খুঁজে পাই তাতে চিন্তার খোরাক। পথহারা আমি দিশা পাই তার প্রতিটি সৃজনে। দেখি নেয়ামতরাজির সারি সারি বৃক্ষমালা, ফুলের মায়াবী বর্ণমালা, পাহাড়ি সৃষ্টির ঝরনাধারা, আকাশে ভাসমান মেঘমালা; আরও কত কী! যেমনটি ফুটে ওঠে পবিত্র কুরআনে। রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর আমি এর দ্বারা সব ধরনের উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি, এরপর আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি, যা নুয়ে থাকে এবং আঙুরের বাগান, জয়তুন, আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত ও সাদৃশ্যহীন। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ করো যখন সেগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্বতার প্রতি লক্ষ করো। নিশ্চয় এগুলোতে নিদর্শন রয়েছে ইমানদারদের জন্য’ (সুরা আনআম : ৯৮)।
বসন্তে মুখরিত হয় পুরো অঙ্গন, যেন পাখিদের কিচিরমিচির ও মিষ্টি সুর বসন্তের আগমনি বার্তা। সব পাখিই বসন্তে সৌন্দর্যের এক ভিন্ন আবহ ছড়িয়ে দেয়। কোকিল, পাপিয়াসহ আরও বিচিত্র পাখির মধুর কণ্ঠে মুগ্ধ হয় সবাই। সবুজ পাতার ফাঁকে পাখির ওড়াউড়িও মন মাতিয়ে তোলে। কোকিলকে বলা হয় বসন্তের পাখি, গানের পাখি। আমাদের দেশে প্রায় ২০ ধরনের কোকিল বাস করে। ১৪ ধরনের দেশি ও ৬ ধরনের পরিযায়ী। কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। পরনির্ভরশীল হলেও মিষ্টি গানের কারণেই মানুষ তাকে ভালোবাসে। বসন্তের শুরুতে অনেক অতিথি পাখি এসেও মুখরিত করে তোলে বিভিন্ন লেক ও হ্রদ। আরও যোগ হয় এর সঙ্গে বাঁশির সুর, কৃষকের গলা ছেড়ে গাওয়া গান। বসন্তের আগমনে নানা ফুলের গন্ধে বয়ে আনা ফাগুনের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ভরে যায় মন। চোখ জুড়িয়ে যায় বাগানের রক্তিম পলাশ, অশোক, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, কাঞ্চন, পারিজাত, মাধবী আর গাঁদার ছোট ছোট ফুলের বাহারি রঙে। রাজধানীবাসীও তাদের নগরজীবনে আজ ভিন্নরূপ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়। কোটি মানুষের কোলাহলপূর্ণ ঢাকা শহরেও মানুষ খুঁজে ফিরে আজ ফাগুনের আনন্দ। এ ঋতুতে আরও ফোটে স্বর্ণশিমুল, রজনীকান্ত, রক্তকরবী, আকআড়কাঁটা, হিমঝুরি, ইউক্যালিপটাস, রক্তকাঞ্চন, কুরচি, কুসুম, গাব, গামারি, গ্লিরিসিডিয়া, ঘোড়ানিম, জংলীবাদাম, জ্যাকারান্ডা, দেবদারু, নাগেশ্বর, পলকজুঁই, পাখিফুল, পালাম, বুদ্ধনারিকেল, মণিমালা, মহুয়া, মাদার, মুচকুন্দ, রুদ্রপলাশ, শাল, ক্যামেলিয়া, বেলিসহ নাম না-জানা হরেক রকম ফুল। খালবিল, নদীনালা আর বিলজুড়ে দেখা যায় সাদা-লাল শাপলা আর পদ্মফুলের মিলনমেলা। পলাশ, শিমুল গাছে লাগে আগুন রঙের খেলা। প্রকৃতিতে চলে মধুর বসন্তের সাজসাজ রব। বসন্ত মানেই পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব ধ্বনি। এসব মনোরম দৃশ্য আমাদের দৃষ্টিকে করে পরিতৃপ্ত, স্মরণ করিয়ে দেয় কুরআনের সে ভাষ্য ‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। আল্লাহ তো অবশ্যই ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু (সুরা নাহল : ১৮)।
বাঙালির ইতিহাস আবেগময়। এ আবেগ যেমন মানুষে মানুষে, তেমনি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতিরও বটে। দিনক্ষণ গুনে গুনে বসন্তবরণের অপেক্ষায় থাকে বাঙালি। কালের পরিক্রমায় বসন্তবরণ আজ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব। আবালবৃদ্ধ, তরুণ-তরুণী মেতে ওঠে বসন্ত উন্মাদনায়। শীতকে বিদায়ের মাধ্যমে চলে বসন্তবরণের আয়োজন। শীতের সঙ্গে তুলনা করে চলে বসন্তকালের পিঠা উৎসবও। পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব কেবল উৎসবে মেতে ওঠার সময় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য, বাঙালি সত্তা। সে ঐতিহ্য-ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারলেই বসন্ত উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে পারবে বাঙালি চেতনাকে। বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্ত রঙিন পুষ্পিত রক্তের স্মৃতির ওপরও রং ছড়ায়। ১৯৫২ সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে হয়ে আছে একাকার। বাংলা পঞ্জিকা বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিনকে বাঙালি পালন করে ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’ হিসাবে। বাঙালির নিজস্ব সর্বজনীন প্রাণের এ উৎসব এখন গোটা বাঙালির কাছে ব্যাপক সমাদৃত।
মহান রবের সৃষ্টির কারুকার্য আমাদের ভাবিয়ে তোলে প্রতিনিয়ত, চিন্তার মাঝে ঢুকিয়ে দেয় প্রতিক্ষণ। বারবার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে মহান রবের অমিয় বাণী ‘পৃথিবীর ওপর যা রয়েছে, সেগুলোকে আমি তার শোভা করেছি মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ’ (সুরা কাহাফ : ৭)।
আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়ার জন্য তার সৃষ্টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। প্রকাশ করতে হবে মুখে, কাজে, সর্বক্ষেত্রে। প্রতিটি ক্ষণ কাটাতে হবে মহান রবের আরাধনায়। তাহলেই প্রকাশ পাবে অপরূপ সৌন্দর্যময় নেয়ামতরাজির জন্য যথাযথ কৃতজ্ঞতা।
প্রিন্সিপাল, শ্যামপুর কদমতলী রাজউক মাদ্রাসা, ঢাকা
