সুন্দরবন রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ চাই
নাফিস আহমেদ
প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি হলো সুন্দরবন। এর আয়তন সর্বমোট ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। তার মধ্যে ৬২ শতাংশ আমাদের বাংলাদেশে এবং বাকি ৩৮ শতাংশ পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত অপরূপ এ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশপরগনা ও দক্ষিণ পরগণাজুড়ে বিস্তৃত। ১৯৯২ সালে এটি রামসার এলাকা ও ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
সুন্দরবনকে বলা হয় আমাদের দেশের ফুসফুস। আমাদের নানা উপকার করে থাকে এ বনভূমি। এ বন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়ংকর সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনগণ ও তাদের সম্পদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবলয় হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুন্দরবন দেশের বনজসম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। আসবাবপত্র ও নিউজপ্রিন্ট, দিয়াশলাই, হার্ডবোর্ড ও নৌকা ইত্যাদি শিল্পের অনেক উপাদান সুন্দরবন থেকে পেয়ে থাকি। এছাড়া এ বনের মধু দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়, যার মাধ্যমে আমরা বৈদেশিক মুদ্রাও পেয়ে থাকি। সুন্দরবনের গোলপাতা ঘরের ছাউনির কাজে ব্যবহৃত হয়। এ পাতা সংগ্রহ করার দ্বারা এবং বনের পর্যটন এলাকা থেকে সরকার বিপুল রাজস্ব আয় করে থাকে। তাছাড়া সুন্দরবনকে ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে।
অসংখ্য উদ্ভিদ ও বিচিত্র সব প্রাণীর এক অনন্য আবাসস্থল সুন্দরবন। বিশ্বের আকর্ষণীয়, রাজকীয় ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর অন্যতম রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে এ বনে। বাঘ ছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির, সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী। এসব উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যের দ্বারা সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান এবং দেশের পরিবেশের ভারসাম্যও টিকে থাকে। কিন্তু এতকিছু মধ্যে দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের দেশের ফুসফুস এখন ভালো নেই। প্রায় প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের গাছপালা ও বন্যপ্রাণীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ বছর ঘূর্ণিঝড় রিমালের অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসে টানা ৩৬-৩৭ ঘণ্টা সুন্দরবন লবণ-পানির নিচে তলিয়ে ছিল। এতে ১৩৪টি হরিণ ও চারটি বন্যশূকর মারা গেছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য চরম হুমকির বিষয়। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে লোনা পানিতে বনের গাছপালা মরে যাচ্ছে। এতে বাঘ ও তার শিকারের আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বাঘের শিকার হারিয়ে গেলে প্রাণীটির টিকে থাকার সম্ভাবনা আরও কমে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে ধারণা করা হচ্ছে, ৫০ বছরের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যা খুবই দুঃখজনক। আবার বনের প্রধান উদ্ভিদ ‘সুন্দরী’ও রয়েছে ঝুঁকির শীর্ষে। সুন্দরী গাছ স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত লোনা পানি সহ্য করতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর ফলে সুন্দরী গাছ নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, অবৈধ বসতি স্থাপন ও অনিয়ন্ত্রিত গাছ কাটায় গত ৩৭ বছরে সুন্দরবন হারিয়েছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার এবং সৌন্দর্যের প্রতীক সুন্দরী বৃক্ষ কমে গেছে প্রায় ২৮.৭৫ শতাংশ, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ।
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান বিঘ্নিত করার পেছনে মানবসৃষ্ট কারণও কম দায়ী নয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটারকে সংকটাপন্ন অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। এখানকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষতি করে এমন কোনো স্থাপনা নির্মাণ কিংবা কোনো কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ অবৈধ। দেখা যাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে একের পর এক রিসোর্ট ও কটেজ গড়ে তোলা হচ্ছে, যা পরিবেশের ক্ষতি করছে। রিসোর্টগুলোর আশপাশে শব্দ ও মাটিদূষণ বাড়ছে, ফলে প্রাণীগুলো ওই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সুন্দরবন রক্ষায় এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের বনভূমিও বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেজন্য সুন্দরবনকে রক্ষা করতে টেকসই উন্নয়ন ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা এখন সময়ের দাবি। এজন্যে দীর্ঘমেয়াদি ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। ঘূর্ণিঝড়ে ও জলোচ্ছ্বাসের সময় পশু-প্রাণীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উঁচু টিলা স্থাপন করা প্রয়োজন। এগুলোর জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা জরুরি। একই সঙ্গে আমাদেরও পরিবেশ নিয়ে সচেতন হতে হবে। সরকার ও সাধারণ জনগণ উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা সুন্দরবনকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ। তাহলে বাঁচবে দেশ, বাঁচবে প্রকৃতি।
প্রাবন্ধিক
