Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

বন্ধ হোক শিশুশ্রম

Icon

এমদাদুর রহমান উদয়

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশে শিশুশ্রম একটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক সমস্যা, যা এখনো লাখ লাখ শিশুর শৈশব ও ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তুলছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও শিশুশ্রমের হার উদ্বেগজনকভাবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশে শিশুশ্রম একটি গভীর সামাজিক সমস্যা হিসাবে বিদ্যমান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি ৩৫ লাখের বেশি শিশু কোনো না কোনো কাজে নিয়োজিত, যার মধ্যে শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে প্রায় ১৮ লাখ শিশু এবং ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত। এ বিপজ্জনক কাজের মধ্যে রয়েছে কৃষি, চামড়া ও পোশাকশিল্প, ইটভাটা, জাহাজ ভাঙা এবং রাস্তার কাজ। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে উপ-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রমের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে, যেখানে শতভাগ শিশু শ্রমিকই অবৈধভাবে নিয়োজিত।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজ করানো নিষিদ্ধ এবং ১৮ বছরের নিচে বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ। তবে এ আইন সব খাতে প্রযোজ্য নয়; যেমন, কৃষি খামার, গৃহকর্ম এবং ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো এ আইনের আওতার বাইরে। শ্রম পরিদর্শন অধিদফতর ২০২৩ সালে ৩,৪৫৯টি শিশুশ্রম লঙ্ঘনের ঘটনা শনাক্ত করেছে এবং ৩,৯৯০ শিশুকে বিপজ্জনক কাজ থেকে উদ্ধার করেছে।

বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমের সংখ্যা ১৬০ মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা গত দুই দশকে প্রথমবারের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। কোভিড ১৯ মহামারির প্রভাব এবং অর্থনৈতিক সংকট বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়। তবে আমাদের দেশে দারিদ্র্য, শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, সামাজিক সচেতনতার অভাব এবং আইন প্রয়োগের দুর্বলতা শিশুশ্রমের মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক পরিবার অতিরিক্ত আয়ের প্রয়োজন অনুভব করায় তাদের শিশুদের কাজ করতে বাধ্য করেন। এছাড়া অনেক শিশুর জন্মনিবন্ধন না থাকায় তাদের বয়স নির্ধারণ করা কঠিন হয়, যা তাদের শ্রমে নিযুক্তির ক্ষেত্রে আইনগত বাধা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে-শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি বৃদ্ধি, মিড-ডে মিল চালু এবং ঝুঁকিপূর্ণ খাতে শিশুদের নিয়োগ বন্ধে আইন প্রয়োগের জোরদার প্রচেষ্টা। তবে তা বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশেষ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ, এ খাতগুলোয় সরকারি পর্যায়ে নজরদারি সীমিত। এছাড়া সামাজিকভাবে শিশুশ্রমকে অনেক সময় স্বাভাবিক হিসাবে দেখা হয়, যা এর নির্মূলে বাধা সৃষ্টি করে।

শিশুশ্রম নির্মূলে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ইউনিসেফের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ও সম্পন্নের হার বৃদ্ধি পেলেও অনেক শিশু মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না, যা তাদের শ্রমে নিযুক্তির সম্ভাবনা বাড়ায়। তাই সব শিশুর জন্য মানসম্মত ও সহজলভ্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু দরিদ্রতা এ সমস্যা সমাধানের প্রধান অন্তরায়, সেহেতু দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারগুলোর জন্য নগদ সহায়তা ও খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পাশাপাশি শিশুশ্রম নিষিদ্ধকরণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে, যারা এ অপরাধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশুশ্রমের উপস্থিতি কমাতে কার্যকর নজরদারির ব্যবস্থা করাও জরুরি। এ ছাড়া সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন এবং ধর্মীয় চেতনার উদ্ভব ঘটাতে হবে। সামাজিকভাবে শিশুশ্রম রোধে এগিয়ে আসতে হবে, যেন সমাজের সব মানুষ শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ধারণা পায়। শিশুশ্রম একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যা সমাধানে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগেই শিশুশ্রম নির্মূল করা সম্ভব। শিশুদের শৈশব রক্ষা এবং তাদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। শিশুশ্রম বন্ধ হোক, শিশুরা ফিরে পাক তাদের হারানো শৈশব।

শিক্ষার্থী, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম