Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

সেবার আলো ছড়িয়ে পড়ুক

Icon

মোহাম্মদ নুরুল হুদা

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শহরকেন্দ্রিক অর্থনীতির ধারা প্রবল হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই গ্রাম থেকে শহর অভিমুখী জনসমাগম বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ বর্তমানে শহরে বসবাস করছে। ২০৪০ সাল নাগাদ এ হার ৫০ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই যে ক্রমবর্ধমান শহরমুখী জনস্রোত, এর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। তারা শহরে আসছেন পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তার আশায়। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, আলো ঝলমলে এসব শহরেই তারা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকছেন, এদের অনেকে অপুষ্ট শরীরে বিরামহীনভাবে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। এসব দরিদ্র মানুষের অধিকাংশই স্বল্পশিক্ষিত ও সাক্ষরজ্ঞানহীন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের শারীরিক সামর্থ্যই তাদের সবচেয়ে বড় পুঁজি; কিন্তু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকায় ও সচেতনতার অভাবে তারা রয়েছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। শ্রমজীবী শ্রেণির এ বিশাল অংশকে এমন ঝুঁকিতে রেখে টেকসই অর্থনীতি কি সম্ভব? উৎপাদনের হাতিয়ার এ কর্মজীবী গোষ্ঠী দুর্বল হয়ে গেলে জাতীয় উৎপাদনশীলতা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলাই যায়।

কাজেই অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে শহরবাসীর মধ্যে যারা অসচ্ছল, শ্রমজীবী নারী-পুরুষ কিংবা তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু এ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে? যেহেতু বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা ব্যয়বহুল, তাই দরিদ্র পরিবারের জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোয় সেবাপ্রদান নিশ্চিতে গুরুত্ব দিতে হবে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ যে কয়টি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন হয়েছে, তার মধ্যে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা অন্যতম। তবে শহরাঞ্চলে স্বল্প আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই ছিল অবহেলিত। বিষয়টিকে তাই গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৯৮ সালে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট শুরু করা হয়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি ২০১২ সালে দ্বিতীয় পর্যায় শেষ করে কোনো বিরতি না রেখেই আরবান প্রাইমারি হেল্থ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট (ইউপিএইচসিএসডিপি) নামে বিস্তৃতি লাভ করে। বর্তমানে ইউপিএইচসিএসডিপি-এর দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পটির অধীনে ১১টি সিটি করপোরেশন এবং ১৮টি পৌরসভা এলাকায় ৪৫টি নগর মাতৃসদন, ১৬৭টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ৩৩৪টি স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শহরবাসী, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মা ও শিশুদের স্বল্পমূল্যে উন্নত প্রাথমিক চিকিৎসা এবং রোগ প্রতিরোধী সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতিদরিদ্রদের মধ্যে ২ লাখের বেশি (ডিসেম্বর, ২০২৪ পর্যন্ত) লাল কার্ড বিতরণ করে তাদের বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের শহরাঞ্চলের ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি মানুষ বর্তমানে এ প্রকল্পে সেবার আওতাভুক্ত।

ব্যয়বহুল চিকিৎসাকেন্দ্রের ভিড়ে শহরে বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠী কোথায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন, এমন প্রশ্নের জবাবে জানাতে চাই, ‘সেবার আলো সবার কাছে’ স্লোগানে উদ্দীপ্ত ইউপিএইচসিএসডিপিভুক্ত রংধনু চিহ্নিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রয়েছে। এখন প্রকল্পের কার্যকারিতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে প্রয়োজন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। উল্লেখ্য, ক্লিনিকে সাধারণ রোগীদের জন্য ডাক্তারের কনসালটেশন ফি ৫০ টাকা, নরমাল ডেলিভারি চার্জ ১২০০ টাকা এবং সিজারিয়ান ডেলিভারি চার্জ ১০,০০০-১২,০০০ টাকা। পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ ফ্রি। এ ছাড়া লাল কার্ডধারীদের চিকিৎসাসেবা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।

মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সামাজিক চাহিদা তৈরি হলে এর মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় রসদের সংস্থান হবে সামাজিকভাবেই। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা খুবই জরুরি। উল্লেখ্য, প্রকল্প এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে ওয়ার্ড আরবান হেল্থ কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার কাজ হবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে দীর্ঘস্থায়ীকরণে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং সেবাগ্রহণ ও প্রদানের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে তার সমাধান করা। জনপ্রতিনিধি ও সচেতন ব্যক্তিমাত্রই অবগত আছেন যে, স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সমাজে জনভিত্তি মজবুত করা সম্ভব। তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে একটি সুস্থ জাতি গঠন সরকারের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য। কারণ, একটি সুস্থ জাতিই নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন টেকসই রাখতে পারে।

উপসচিব ও উপপ্রকল্প পরিচালক, আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম