|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য পর্বতসম শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে ঝরেছে হাজারো প্রাণ। জনগণের চাওয়া-দলীয় প্রভাবে অন্যায়ের প্রশ্রয়, চাঁদাবাজি, ঘুস, মূল্যস্ফীতি, লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি থেকে মুক্তি। দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট শাসনামলের অবসান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় আধিপত্যবাদেরও পতন হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিকসহ সচেতন বুদ্ধিজীবী মহল একবাক্যে এ কথা স্বীকার করেন। তবে ভারতের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ কি অন্য কোনো পরাশক্তির শিবিরে প্রবেশ করছে? যদি করে, তাহলে আদৌ কি কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণের দিকে বাংলাদেশ? বর্তমান সরকার আগের সব বৈষম্যমূলক আইন, বিচারব্যবস্থা, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতি-মোট কথা, সংবিধানকে যুগোপযোগী করে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। লক্ষ্য হলো-নিজেদের স্বার্থ হাসিলে অন্যের প্রেসক্রিপশনে দেশের ক্ষতি না করা এবং রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ না করা। কিন্তু বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানামুখী কাজ বেশ প্রশংসা কুড়ালেও অনেক বিষয় আবারও ভাবিয়ে তুলছে। কারও কারও আশঙ্কা, এ দেশ আবারও অন্য কোনো শক্তির বলয়ে প্রবেশ করছে না তো?
বিষয়টি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাক। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিটি সম্প্রতি যে সুপারিশমালা দিয়েছে, এতে বিদেশি শক্তির প্রভাব আছে বলে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো বলছে। তাদের মতে, বিদেশিদের ধার করা সংস্কৃতি এ দেশে চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কমিশনের প্রস্তাব হলো-পুরুষের মতো নারীর সমান সম্পত্তি লাভ, যৌনকর্মীকে শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি, ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনে নারীর প্রতি বৈষম্য থাকায় অভিন্ন পরিবারিক আইন তৈরি করা ইত্যাদি ধর্মীয় মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ন করে পশ্চিমা নীতি চালু করার শামিল। আবার, সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করে সেখানে ‘বহুত্ববাদ’ অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এতে দেশে যারা মূলত অপসংস্কৃতি লালন করে, যেমন-এলজিবিটিকিউ ইত্যাদির দৌরাত্ম্য বাড়বে। কারও কারও আশঙ্কা, এতে আধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতিকে কৌশলে বাংলাদেশে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় জাতিসংঘ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সে অঞ্চলে প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য মানবিক করিডরের প্রস্তাব করেছে। এ নিয়ে বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক মহলে সৃষ্টি হয়েছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকারের তরফে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে, জুলাই অভ্যুত্থানের পর ভারতের আধিপত্য হ্রাস পাওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন করে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিকসহ নানা কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা হচ্ছে। আবার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মার্চে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী ও পানি ব্যবস্থাপনায় টেকস?ই পরিকল্পনায় চীনের কাছে ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছেন। এ ছাড়া তিস্তা মহাপরিকল্পনায় অংশ নিতে বাংলাদেশ চীনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চীনের সরকার ও কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ২১০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। আরও জানা যায়, চীনের প্রায় ৩০টি কোম্পানি বাংলাদেশের বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। এ ছাড়া চীন মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে প্রায় ৪০ কোটি ডলার ঋণ প্রদান, চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫ কোটি ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসাবে আরও ১৫ কোটি ডলার বরাদ্দ প্রদানের পরিকল্পনা করেছে। বাকি অর্থ অনুদান ও অন্যান্য ঋণ সহায়তা হিসাবে আসবে। এ বিষয়ে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেছেন, ‘সুদের হার, শর্ত, প্রযুক্তি এবং কম খরচ হবে, এসব চিন্তা করেই বাংলাদেশ প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের সহায়তা প্রত্যাশা করে। কস্ট বেনিফিট বিবেচনায় নিলে যেখান থেকে ঋণ পেলে সুবিধা, সেদিকেই তো যাব আমরা। সে জন্যই চীন গুরুত্বপূর্ণ।’
তবে অর্থনৈতিক কর্মযযজ্ঞের মাধ্যমে চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা কতটুকু রয়েছে, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। বিবিসি, দ্য জিওপলিটিক্স ও দ্য ডিপ্লোম্যাটের মতো গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন বলছে, বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি অনুশীলনের অভিযোগ করে আসছে পশ্চিমা দেশগুলো। তাদের দাবি, চীনের ঋণসংক্রান্ত কার্যকলাপ একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এমন সব দেশকে লক্ষ করে চীন ঋণ দিয়ে থাকে; যাদের দেনা পরিশোধের ক্ষমতা তেমন নেই বললেই চলে। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার দেশ কোস্টারিকা, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, গুয়াতেমালা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
তাই বাংলাদেশে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যারা আসবে, তারা যদি দূরদর্শী চিন্তা না করে, তাহলে হয়তো দেশ নতুন কোনো সমস্যায় জড়াবে। সে আশঙ্কা যাতে সত্যি পরিণত না হয়, সেজন্য দেশের মেধাকে সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করাতে হবে। বাংলাদেশ থেকে যেন মেধা পাচার না হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। কারণ, উন্নত দেশগুলো দেশের মেধার সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করে থাকে। যদি এখনো অতি পরনির্ভরশীলতা ও দেশীয় মেধার পরিবর্তে বিদেশ থেকে ধার করা মেধাকে দেশ উন্নয়নে কাজে লাগানোর প্রবণতা থেকেই যায়, তাহলে আমরা কতটুকু উন্নতির সুঘ্রাণ পাব, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
