ফারাক্কা লংমার্চ ও ভাসানীর বজ্রকণ্ঠ
মারসিফুল আলম
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সময়টা ১৯৩৪। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ তখন ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তখন পদ্মা যেন কেবল একটি নদী নয়, এ ছিল বাংলার আত্মা, ছিল হাজারো কৃষক, মাঝি, জেলে আর শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার শ্রাবণধারা। সেই উত্তাল স্রোত আর প্রাণবন্ত প্রবাহে গড়ে উঠেছিল এক অনন্য নদীনির্ভর সভ্যতা। কিন্তু আজ পদ্মা যেন এক মরুভূমির প্রতিচ্ছবি। শুষ্ক মৌসুমে নিঃসার, ধূসর। নদীর বুক ফেটে উঠেছে বালুচর, বাড়ছে লবণাক্ততা, মরে যাচ্ছে মাছের রেণু, এ অঞ্চলের কৃষক হারাচ্ছে জীবিকা। অথচ এ সংকট হঠাৎ করে আসেনি, এর পেছনে রয়েছে নীতিহীন ও একতরফা আধিপত্যের দীর্ঘ ইতিহাস।
১৯৬১ সালে ভারত যখন হুগলি নদীর নাব্য রক্ষার নামে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে, তখন পাকিস্তান কিছুটা প্রতিরোধ গড়লেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় এ নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতিকে পাশ কাটিয়ে চালু করা হয় ফারাক্কা বাঁধ। ভারতের একতরফা এই সিদ্ধান্ত ছিল প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রতি এক অপমানজনক আচরণ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ তখন অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, সমর্থন আর সহযোগিতা লাভের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিত্র খুঁজতে ব্যস্ত। অন্যায় এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার মানুষ কোথায়? আর ঠিক তখনই আবির্ভূত হন ইতিহাসের এক বিস্ময় পুরুষ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে, রাজশাহীর মাটি থেকে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন : পানি চাই, পানি চাই, পানি চাই! তার এ আহবান যেন ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলল। লাখ লাখ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা তার ডাকে সাড়া দিয়ে রাজশাহী থেকে ফারাক্কা অভিমুখে ১০০ কিলোমিটারের লংমার্চে পা বাড়াল। একদিকে ভারতীয় আধিপত্য, অন্যদিকে বাংলাদেশের অসহায় নীরবতা-এ দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ৯৬ বছর বয়সি এই মানুষটি বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলেন : জীবন দেব; কিন্তু মাথা নত করব না!
সেদিন কানুপুর ঘাটের জনসভায় ভাসানী বলেন, ‘আজ আমরা এসেছি পদ্মার তীরে, দেশের প্রাণ এ নদীর জন্য। ভারত আমাদের পানি কেড়ে নিচ্ছে, আমাদের কৃষককে মেরে ফেলছে, আমাদের জমিকে শুকিয়ে মরুভূমি বানাচ্ছে।’ সেই কণ্ঠ, সেই ভাষণ, সেই মার্চ-এগুলো শুধুই প্রতিবাদের ছিল না, ছিল আত্মমর্যাদার এক মহামিছিল। ছিল জন্মভূমির প্রতি অঙ্গীকার, ছিল রাষ্ট্রীয় অধিকার রক্ষার এক অগ্নিশপথ। ভাসানীর নেতৃত্বে এই লংমার্চ ছিল জল ও জীবন রক্ষার জন্য এক পবিত্র সংগ্রাম। তার মুখে যখন উচ্চারিত হয়, ‘আমরা ভিক্ষা চাই না, অধিকার চাই’, তখন তা হয়ে ওঠে এক স্বাধীন জাতির আভিজাত্য ও সাহসের প্রতীক।
আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য ফারাক্কা লংমার্চ কেবল একটি আন্দোলনের নাম নয়, এটি হলো এক জীবন্ত ইতিহাস, এক অদম্য চেতনা, যা শেখায় কীভাবে একজন মানুষ পুরো জাতিকে পথে নামাতে পারে। কীভাবে সাহস, নেতৃত্ব ও ভালোবাসা দিয়ে বদলে দেওয়া যায় একটি জাতির ভাগ্যের গতিপথ। মওলানা ভাসানী দেখিয়ে দিয়েছেন-প্রকৃত নেতা হতে হলে বয়স নয়, প্রয়োজন হয় সাহসের; প্রয়োজন হয় সত্যের প্রতি অটল বিশ্বাস আর মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এখন সময় এসেছে ভাসানীর মতো করে আবার বলার, ‘আমরা শান্তি চাই, পানি চাই। যদি তা না পাই, আমাদের হিস্যা আমরা বুঝে নেব!’
শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
