ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বর্তমানে আমাদের দেশসহ গোটা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দিনদিন বাড়ছে তাপমাত্রা, যার প্রভাবে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী দাবদাহ। অতিরিক্ত গরমে শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি ও প্রকৃতির ভারসাম্যও মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। তাপজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণহানির ঘটনাও বাড়ছে। কোথাও অনাবৃষ্টি, কোথাও অতিবৃষ্টি; মরুকরণ দেখা দিচ্ছে অনেক এলাকায়, যার ফলে কৃষিজ উৎপাদন কমছে এবং জীববৈচিত্র্যের হুমকি বাড়ছে। এ অবস্থায় পরিবেশ রক্ষার অন্যতম কার্যকর উপায় হচ্ছে সবুজায়ন।
তাপমাত্রা যখন সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন শুধু অস্বস্তি নয়, বরং তা প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, ত্বকের জটিলতা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি সমস্যা বাড়ছে। বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে অনাবৃষ্টি কিংবা অতিবৃষ্টি, যা কৃষির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। একদিকে ফসল নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে পানি সংকট তীব্রতর হচ্ছে। এমনকি দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে মাটি হারাচ্ছে উর্বরতা, মরুকরণ শুরু হয়েছে। বিশ্বজুড়ে গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়া থামাতে না পারলে ভবিষ্যৎ পৃথিবী হবে আরও বেশি উত্তপ্ত, শুষ্ক ও বসবাসের অযোগ্য। আর এ সংকট নিরসনে আমাদের হাতে এখনই যেটি সবচেয়ে কার্যকর ও সহজলভ্য উপায়, তা হলো সবুজায়ন। গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, বায়ু পরিশোধন করে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। গাছপালা ছাড়া পৃথিবীতে কোনো প্রাণীর টিকে থাকা সম্ভব নয়। অথচ শহর কিংবা গ্রামে প্রতিনিয়ত গাছ কেটে তৈরি করা হচ্ছে নতুন ভবন, রাস্তা কিংবা শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এই অতি-নির্মাণ কার্যক্রম পরিবেশকে নষ্ট করছে চুপিচুপি।
সবুজায়নের মাধ্যমে আমরা শুধু পরিবেশকে রক্ষা করতে পারি না, বরং আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করে তুলতে পারি। একটি গাছ কেবল ছায়া বা অক্সিজেনই দেয় না; তা খাদ্য, ওষুধ, কাঠ, জীববৈচিত্র্য, এমনকি কর্মসংস্থানের উৎস হিসাবেও কাজ করে। ফলজ গাছ যেমন মানুষের দৈনন্দিন পুষ্টির চাহিদা মেটায়, তেমনই তা গ্রামীণ অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখে। বনজ গাছ থেকে প্রাপ্ত কাঠ ঘরবাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে নানা শিল্পে ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে, ঔষধি গাছ বহু পুরোনো আয়ুর্বেদিক ও লোকজ চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচিত। পরিকল্পিতভাবে ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব, অন্যদিকে তা স্থানীয় জনগণের জন্য আয়বর্ধক একটি পথও খুলে দিতে পারে। জমির ব্যবহারের উপযোগিতা বাড়লে কৃষি-উৎপাদনেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক পরিবার এসব গাছের ফল ও উপাদান বিক্রি করে অতিরিক্ত আয় করছে, যা তাদের জীবনের মান উন্নয়নে সহায়ক হচ্ছে। তাই সবুজায়ন এখন আর কেবল প্রকৃতি রক্ষার উপায় নয়, বরং এটি গ্রামীণ ও জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক ফাঁকা জমি রয়েছে, যেগুলোতে পরিকল্পিতভাবে ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগান যেতে পারে। সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, শিক্ষিত যুবক-যুবতি, কৃষক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসা উচিত গাছ লাগানোর ব্যাপারে। সরকারি রাস্তার পাশে কিংবা খালি জমিতে গাছ রোপণ করে পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি সৌন্দর্যও বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া স্থানীয় এনজিও ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গাছ রোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে, যাতে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ে। শহরের সমস্যা হলো জায়গার অভাব; কিন্তু এর মধ্যেও উপায় আছে। ছাদবাগান এখন শহরের সবুজায়নে এক নতুন বিপ্লব। বাড়ির ছাদে ছোট ছোট পাত্রে গাছ লাগিয়ে শুধু পরিবেশের উন্নয়ন নয়, বরং পারিবারিক প্রয়োজনও মেটানো যায়। বিভিন্ন ধরনের সবজি, ফলমূল, ফুল ও ঔষধি গাছ ছাদে চাষ করা যায়। এটি শুধু সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, বরং শহরের তাপমাত্রাও কিছুটা কমায় ও কার্বন নিঃসরণ রোধে সাহায্য করে। শহরের অন্যান্য জায়গা যেমন-দেওয়াল, স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণ, পার্ক, খেলার মাঠ, অফিস, হাসপাতাল চত্বর ইত্যাদি স্থানেও গাছ রোপণের সুযোগ রয়েছে। যত্রতত্র যান চলাচলের ফলে যে ধুলাবালি ও দূষণ ছড়ায়, তা রোধ করতে রাস্তার পাশে গাছ লাগানো অত্যন্ত কার্যকরী।
গাছ শুধু লাগালেই হবে না-সঠিক স্থান, সময়, আবহাওয়া, মাটির ধরন, আশপাশের পরিবেশ ও বসতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে গাছ নির্বাচন করাটাও অত্যন্ত জরুরি। আবার শুধু গাছ লাগানোই যথেষ্ট নয়, এর সঠিক পরিচর্যার প্রয়োজন। প্রতিটি এলাকায় গাছের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয়ভাবে দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা কমিটি নির্ধারণ করা জরুরি। শিক্ষার্থীরা যদি ছোটবেলা থেকেই গাছের যত্ন নিতে শেখে, তবে ভবিষ্যতে তারা পরিবেশবান্ধব নাগরিক হয়ে উঠবে। নতুন প্রজন্মের হাতে গাছ তুলে দেওয়ার জন্য সমাজে এক ধরনের সৃজনশীল সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন খেলাধুলা, সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসাবে গাছের চারা উপহার দেওয়া যেতে পারে। সামাজিক, ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে স্মারক হিসাবে গাছ উপহার দেওয়ার চল শুরু করা যেতে পারে। এতে গাছ কেবল প্রকৃতির উপাদান নয়, বরং ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের প্রতীক হয়ে উঠবে। পরিবেশ সুরক্ষায় শুধু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। এ সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ এবং তার বাস্তবায়ন। সরকারকে অবশ্যই সবুজায়ন সংক্রান্ত একটি সুদৃঢ়, বাস্তবভিত্তিক এবং পরিবেশবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। গাছ কাটার ক্ষেত্রে কঠোর অনুমতি প্রক্রিয়া চালু করতে হবে এবং যেখানে গাছ কাটা হবে, সেখানে সমপরিমাণ গাছ রোপণ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এছাড়া, নগর পরিকল্পনায় গাছ ও খোলা জায়গার জন্য নির্দিষ্ট অনুপাত নিশ্চিত করতে হবে। তবে শুধু সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব এড়ানো চলবে না। আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। নাগরিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পরিবেশগত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আসুন, গাছ লাগাই, প্রাণ বাঁচাই।
গণমাধ্যম কর্মী
