Logo
Logo
×

বাতায়ন

ন্যায়কণ্ঠ

সংসদ ভেঙে যাওয়া ও নির্বাচনবিষয়ক বিধান

Icon

ইকতেদার আহমেদ

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংসদ ভেঙে যাওয়া ও নির্বাচনবিষয়ক বিধান

জাতীয় সংসদ

সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভেঙে দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত হলেও রাষ্ট্রপতি তার এ দায়িত্বটি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী পালন করে থাকেন। সংসদের মেয়াদ হল সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান-পরবর্তী প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর; তবে এ ক্ষেত্রেও মেয়াদ পূর্তির পূর্বে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সংসদ ভেঙে দিতে পারেন।

সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও প্রজাতন্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত থাকাকালে সংসদের আইন দ্বারা এর মেয়াদ এককালে অনধিক এক বছর বৃদ্ধি করা যায়; তবে যুদ্ধ শেষ হলে বর্ধিত মেয়াদ কোনোক্রমে ছয় মাস অতিক্রম করতে পারবে না।

আবার সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর এবং সংসদের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে রাষ্ট্রপতির কাছে যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, প্রজাতন্ত্র যে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে, সে যুদ্ধাবস্থার বিদ্যমানতার জন্য সংসদ পুনঃআহ্বান করা প্রয়োজন, তাহলে যে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি তা আহ্বান করবেন। এ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য সমাধা করতে হয়।

রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পাঁচ বছর। প্রধানমন্ত্রী পদের নির্ধারিত মেয়াদ না থাকলেও তিনি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন না হারানো অবধি তার পদত্যাগের আবশ্যকতা দেখা দেয় না। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ে তাদের উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পদে বহাল থাকেন।

সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর এবং সংসদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী বা অপর কোনো মন্ত্রী নিয়োগের আবশ্যকতা দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত আগে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন তাদের মধ্য থেকে অনুরূপ নিয়োগকার্য সম্পন্নের বিধান রয়েছে।

২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সংসদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে যে বিধান করা হয় তাতে বলা হয়- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সংসদ ভেঙে যাওয়া পূর্ববর্তী সংসদ নির্বাচন সংসদ বহাল থাকাবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়। এরূপ সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিরা সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করতে পারেন না।

সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ষাট দিনের অতিরিক্ত বিরতি না থাকার বিধান থাকলেও সংসদ বহাল থাকাবস্থায় নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন নব্বই দিন সময়ের মধ্যে সংসদের অধিবেশন আহ্বান করা যায় না।

সচরাচর দেখা যায় সংসদে প্রধানমন্ত্রী যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন সে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে অথবা অন্য কোনো দল একক বা যৌথভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাছাড়া সংসদ নির্বাচন গোলযোগ ও কলুষতাপূর্ণ হলে অথবা সংবিধানের বিধানাবলির ব্যত্যয়ে সংসদ গঠিত হলে বিরোধী দল বা জনদাবির মুখে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। আমাদের দেশে ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ এ চারটি সংসদ বিরোধী দলের পদত্যাগ অথবা জনদাবির মুখে ভেঙে দেয়া হয়েছিল।

আমাদের ৬ষ্ঠ ও ১০ম সংসদ নির্বাচন সমমাত্রার গোলযোগ ও কলুষতাপূর্ণ ছিল; তবে প্রথমোক্তটির সঙ্গে শেষোক্তটির পার্থক্য হল বিরোধী দল তথা জনদাবির মুখে প্রথমোক্তটিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিধানের আইন কার্যকর করে এটি ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়, অপরদিকে শেষোক্তটি অনুষ্ঠানকালীন এটিকে নিছক নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলে অচিরেই সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে এমন আশ্বাসের বাণী শুনানো হলেও পরবর্তীকালে সে পথে না গিয়ে এ সংসদটিকে মেয়াদ পূর্তির দিকে নিয়ে গিয়ে ১০ম সংসদ নির্বাচনের ন্যায় ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।

১০ম সংসদ নির্বাচনটি ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ নির্বাচনটিতে অংশগ্রহণ করেনি। অনুরূপ দাবিতে ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনেও তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে।

১০ম সংসদে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও জনমতের বিচারে এটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল। এ দলটির অন্তর্ভুক্তিতে সম্প্রতি যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছে তারা উপর্যুপরি সরকারের কাছে দাবি করে আসছে সংসদ ভেঙে দিয়ে যেন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের এ দাবি সংবিধানসম্মত নয়- ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের পক্ষ থেকে এ যুক্তি প্রদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে আইন বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, অতীতে বর্তমানের মতো নির্বাচন সংক্রান্ত বিধান কার্যকর থাকাকালীন বিরোধী দল বা জনদাবির মুখে সংসদ ভেঙে দিয়ে একাধিকবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারা আরও ব্যক্ত করেন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা সংসদ ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় নয়। আর সংসদ ভেঙে দেয়া হলে সংবিধানসম্মতভাবেই ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সংসদ বহাল থাকাবস্থায় সংসদের কোনো সদস্যপদ শূন্য হলে পদটি শূন্য হওয়ার নব্বই দিনের মধ্যে ওই শূন্য পদ পূরণের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয়; তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতে, দৈবদুর্বিপাকের কারণে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে ওই মেয়াদের শেষদিনের পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে।

নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত। কমিশনের সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার সভাপতিত্ব করলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রাধান্য পায়। নির্বাচন কমিশনের জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ক সব সিদ্ধান্ত কমিশনের সভায় গ্রহণ করার বিধান থাকলেও দৈবদুর্বিপাকজনিত কারণে সংসদ সদস্যের কোনো শূন্য পদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় অতিরিক্ত নব্বই দিন বৃদ্ধি করার আবশ্যকতা দেখা দিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এককভাবে সে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করতে পারেন।

দৈবদুর্বিপাকজনিত কারণে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় বৃদ্ধি করা যায় কিনা- এমন প্রশ্নের অবতারণায় সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ ও এর শর্তাংশ অধ্যয়নে ধারণা পাওয়া শর্তাংশটি সংসদ সদস্যের শূন্য পদে অনুষ্ঠানবিষয়ক দফার সঙ্গে যুক্ত। সংবিধান প্রণয়নকালীন এ শর্তাংশটি মূল দফার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটিকে মূল দফার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন ঘটে।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনবিষয়ক বিধানটি ’৭২-এর সংবিধানের সংসদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ক বিধানের সমরূপ। এ বিধানটি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রবর্তন অবধি কার্যকর থাকাকালীন সংসদের যে ছয়টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এর কোনোটির ক্ষেত্রেই সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারায় এটির অনুসরণে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি।

সংসদের সদস্য পদ শূন্য হওয়া বিষয়ে নির্বাচন বিষয়ক যে বিধান তা সংবিধান প্রণয়ন পরবর্তী পূর্বাপর অক্ষুণ্ণ রয়েছে, যদিও সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিধানটির সঙ্গে দৈবদুর্বিপাকজনিত শর্তাংশটি যুক্ত হয়।

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যেমন সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভেঙে দেন, অনুরূপ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং ভেঙে যাওয়া সংসদ পুনরায় আহ্বান করতে পারেন। সংসদ বহাল থাকাবস্থায় যৌক্তিক কারণে যে কোনো সময় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য পরামর্শ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে থাকলেও সংসদের কার্যক্রম বহাল নেই এমন প্রশ্নে সংসদ ভেঙে না দেয়ার পক্ষের যুক্তি যথার্থ বিবেচিত নয়। সংসদের কার্যক্রম বহাল না থাকলেও সংসদ সদস্যরা সংসদ বহাল থাকার কারণে সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন, ভাতা ও সুযোগসুবিধাদি গ্রহণ করে থাকেন। এরূপ বেতন, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধাদি গ্রহণ করার কারণে তারা নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হলে তাদের অবস্থান অন্য যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে হয় ভিন্নতর। এ বাস্তবতায় এরূপ অসম অবস্থান সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্ব শর্ত সমসুযোগ সংবলিত মাঠ সৃষ্টির পথে বড় ধরনের অন্তরায়।

ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

iktederahmed@yahoo.com

 

সংসদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম