Logo
Logo
×

বাতায়ন

রোকেয়া দিবস

স্বপ্নদ্রষ্টা বেগম রোকেয়া

Icon

নাছিমা বেগম

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ১৯০৫ সালে তার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামক কল্পকাহিনীটি ইংরেজিতে ‘Sultana's Dream’ নামে লিখেছিলেন। বেগম রোকেয়া তার সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক দূরে দেখতে পেতেন। আর এজন্যই তিনি কল্পনার রথে চড়ে এত সুন্দর করে অন্তঃপুরের নারীদের রাজ্যক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন বুনতে পেরেছিলেন।

‘সুলতানার স্বপ্ন’ রচনার পটভূমিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, শারদীয় পূর্ণিমার রাতে লক্ষ-কোটি তারার মাঝে পূর্ণগৌরবে শোভিত চাঁদটি হীরার দ্যুতিতে যখন দেদীপ্যমান, তখন খোলা জানালায় মৃদুমন্দ বাতাসের সঙ্গে বাগানের বেলি ফুলের মিষ্টি সুবাসে আনন্দে আত্মহারা হয়ে তিনি অনেকটা মোহাবিষ্ট অবস্থায়, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিলেন। রোকেয়া তার কল্পকাহিনীতে উল্লেখ করেছেন, ‘ঠিক বলিতে পারি না আমি তন্দ্রাভিভূত হইয়াছিলাম কিনা;- কিন্তু যতদূর মনে পড়ে, আমার বিশ্বাস আমি জাগ্রত ছিলাম।’

বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানা’ এক অপরিচিত রমণীকে ভগিনী সারা মনে করে তার আমন্ত্রণে তার সঙ্গে বেড়াতে বের হয়ে নানা সৌন্দর্য উপভোগ করেন। তার ইতস্ততা ও সংকোচ দেখে ওই রমণী তাকে জানালেন- এটি নারীস্থান, এখানে কোনো পুরুষের সম্মুখে পড়তে হবে না। সুতরাং তার ভয় নেই। সুলতানা তখন এই অপরিচিত নারীকে ভগিনী সারা মনে করেই কথা বলতে শুরু করলেন। তার সঙ্গে শহর ঘুরে শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করে তার মনে হল ভারতবাসী ইচ্ছা করলে কলকাতাকে এর চেয়েও সুন্দর করে তুলতে পারে।

বেগম রোকেয়ার কল্পনার জগৎ এত সুন্দর, এত সমৃদ্ধ যে, কখনও কখনও তা আজকের বাস্তবতাকেও হার মানায়। যেমন এই কাহিনীতে একটি নগরের দৃশ্যের এত সুন্দর-মনোরম বর্ণনা দিয়েছেন, যা তিনি আগে দেখেননি। নীল স্বচ্ছ আকাশের বর্ণনার পাশাপাশি সুন্দর তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তরের বর্ণনা করেছেন। যা দেখে তার মনে হয়েছে মখমলের গালিচা পাতা। এজন্য রাজপথে পা দিতে গিয়ে এত সুন্দর পুষ্পস্তবক পদদলিত করতে চাননি।

গল্পের এক অংশে ভগিনী সারা সুলতানাকে বলেন, কেবল শারীরিক বল বেশি হলে কেউ প্রভুত্ব করবে এটা তারা স্বীকার করেন না। কারণ, সিংহ বলে-বিক্রমে মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হলেও তারা মানবজাতির ওপর প্রভুত্ব করে না। সুতরাং নারীরা সমাজের ওপর কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়ে একাধারে নিজের প্রতি অত্যাচার এবং স্বদেশের অনিষ্ট দুই-ই করেছেন। নারীস্থানের নারীরা তাদের বুদ্ধির জোরেই পুরুষদের অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ করেছেন। ভগিনী সারা অফিসের কাজকর্মের পাশাপাশি নানারকম সলমা-চুমকির কারুকার্যখচিত কাজও করেন। তিনি দুই ঘণ্টায় তার অফিসের দৈনিক কাজ শেষ করতে পারেন বলে জানান। পুরুষরা যে কাজ সাত-আট ঘণ্টায় করে, সে কাজ যে দুই ঘণ্টায় করা সম্ভব, তার ব্যাখ্যাও তিনি করেন।

বেগম রোকেয়া এখানে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, একজন নারী দফতরের কাজের পাশাপাশি সংসারের কাজকর্মও সুন্দরভাবে সমাপ্ত করতে পারেন। অফিসের কাজ কর্তব্যনিষ্ঠা ও মনোযোগসহকারে করলে যে দুই ঘণ্টাতেই করা সম্ভব, তার অকাট্য যুক্তি তিনি তুলে ধরেছেন। আমি নিজেও বিভিন্ন পদমর্যাদায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অফিসের ডেস্কওয়ার্কে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। অফিসে আমাদের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত হয় বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, বেগম রোকেয়া সে সময়েই অনুধাবন করতে সমর্থ ছিলেন অফিসের মূল কাজ করতে কার্যত কতটুকু সময় দরকার।

বেগম রোকেয়া আজ থেকে একশ’ দশ-পনেরো বছর আগে নারীর শিক্ষার গুরুত্ব দিয়ে পল্লীগ্রামেও উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বুনে গিয়েছেন। বাল্যবিয়ে যে নারীশিক্ষার অন্তরায়, তা তিনি চিহ্নিত করেছেন। এটি অচিন্তনীয় যে, সেই সময়ের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে এ ধরনের একটি ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছিল, যেখানে কন্যার বিয়ের বয়স একুশ। তিনি কতটা সাহসী ছিলেন এতেই প্রতীয়মান হয়। নারীস্থানে নারীদের শিক্ষার জন্য দুটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং সেখানে বালকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি শুধু যে নারীশিক্ষার জন্যই চেষ্টা করে গেছেন, নারীকে জাগাতে চেয়েছেন তাই নয়, তিনি অত্যন্ত আধুনিক ও বিজ্ঞানমনষ্ক ছিলেন। তিনি অনেক সুন্দর একটি দেশের কল্পনা করে গেছেন। স্বপ্ন বুনে গেছেন, যেখানে কোনো অকালমৃত্যু হবে না। যেখানে রাস্তাঘাটে কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না। যেখানে মানুষ ‘নারী-পুরুষ’ হিসেবে নয়, দু’জনেই মানুষ হিসেবে কাজ করবে। কেউ কাউকে অবমূল্যায়ন করবে না। যার যার জায়গা থেকে কাজ করবে। শারীরিক শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা দুটিকেই কাজে লাগিয়ে একটি দেশকে কীভাবে সুখের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা যায়, সেই স্বপ্ন রচনা করে গেছেন তিনি। কার্যত ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কল্পকাহিনীটিকে আমরা আধুনিক ‘সায়েন্স ফিকশনের’ সঙ্গে তুলনা করতে পারি। কারণ, বেগম রোকেয়া তার যুগের চেয়ে অনেক বেশি বিজ্ঞানমনষ্ক, আধুনিক চিন্তাশীল ছিলেন। তিনি সেই সময়েই বসে সৌররশ্মি ব্যবহার করে সংসারের দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করার কথা চিন্তা করতে পেরেছেন। সৌররশ্মিকে যুদ্ধে জেতার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি মাঠের ফসল ফলানোর কাজে ব্যবহারের চিন্তা করেছেন। বৃষ্টির পানিকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রয়োজনমতো ব্যবহারের চিন্তা করেছেন। বর্তমান বিশ্বে ঠিকই সৌররশ্মির ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। বৃষ্টির পানিকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিচ্ছি। বৃষ্টির পানি মানুষের জন্য কতটা নিরাপদ, এটা আমরা সবাই জানি। সূর্যের আলোকে ব্যবহার করতে পারলে আমাদের বৈদ্যুতিক যে চাহিদা আছে, বিদ্যুতের যে অভাব আছে, তার অনেকটাই আমরা নিরসন করতে পারি। তিনি একজন নারী হয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষা লাভ না করেও নিজের চেষ্টায়, নিজের চিন্তা-চেতনা দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন। তিনি চিন্তাধারায় নিজেকে আধুনিক করতে পেরেছিলেন বলেই এ ধরনের স্বপ্ন বুনতে সমর্থ হয়েছিলেন, যা আজকে আমরা আমাদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাঝে দেখতে পাই। তাকে বেগম রোকেয়ার স্বপ্নদেখা রাষ্ট্রনায়কের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখতে পাই। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি, ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও স্বপ্ন বুনছেন। তিনি ইতিমধ্যে ২০২১ সালের রূপকল্প, ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ এবং ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যান তৈরি করেছেন। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে, কেমন করে এগিয়ে যাবে, কেমন করে নেতৃত্ব দেবে- তিনি সেই স্বপ্ন রচনা করে যাচ্ছেন। পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দিয়েছেন বাস্তবায়নের জন্য। একুশ শতকের বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছেন আগামী প্রজন্মের হাতে। সবকিছু মিলিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পূর্বসূরি স্বপ্নদ্রষ্টা বেগম রোকেয়ার কাছে আমরা আজীবনের জন্য ঋণী হয়ে রইলাম।

নাছিমা বেগম : সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম