ভোটার মনের শঙ্কা দূর করুন
ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নগর-শহর পেরিয়ে গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল বেজে চলেছে। চায়ের স্টলগুলোতেও দুধসরযুক্ত ধোঁয়াশে চা অথবা হেমন্তের নতুন চালের ভাপা পিঠার মৌ-মৌ গন্ধ ছাপিয়ে জমে উঠেছে নির্বাচনী আলোচনা ও বিতর্ক। আর মাত্র কয়েকটি দিন। তারপর এ মহাযজ্ঞের সাজসাজ রবের যবনিকাপাত ঘটবে।
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে গঠিত হবে নতুন একটি সংসদ। এটাই জাতির এ মুহূর্তের প্রত্যাশা! এর মধ্যেই জনগণ জেনে গেছেন তাদের নির্বাচনী এলাকার সংসদীয় কাণ্ডারী পদে কারা প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন। শত বিপত্তির মাঝেও এমন একটি উৎসবমুখর পরিবেশ জাতির জন্য বেশ আশা জাগানিয়া ব্যাপার বৈকি!
মোটামুটি সবাই অবগত আছেন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা। যেনতেন একটি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সবাই ভেবেছিলেন এ সংসদ বেশিদিন টিকবে না। কিন্তু কোনোভাবে সেটা টিকে গেছে পুরো পাঁচটি বছর। যা হোক, একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু প্রার্থীদের হলফনামার বিবরণ অনুযায়ী গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে- গত ১০ বছরে কেউ কেউ তাদের বৈধ আয়ের চেয়ে ৫২৭ গুণ বেশি সম্পদ অর্জন করেছেন (প্রথম আলো, ০৮.১২.২০১৮)!
সিপিডির রিপোর্ট অনুযায়ী গত দশ বছরে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে (আমাদের সময়, ০৮.১২.২০১৮)! দেশের কোটিপতি ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এর কারণ হল গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো জনঅংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন কর্মসূচি না হয়ে একতরফা উন্নয়নসূচি ছিল। যেখানে পরিকল্পিত উপায়ে কাজ না করে দ্রুত দায়সারা কাজ করানো হয়েছে। এসডিজি অর্জনের রূপরেখার কথা বলা হলেও সেগুলো না মানায় টেকসই উন্নয়ন হয়নি।
ফলে দেখা গেছে রাস্তা-ব্রিজ তৈরি বা মেরামতের ছয় মাস না যেতেই তা ভেঙে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। উন্নয়ন ব্যয় বহুবার বহুগুণ বর্ধিত করে হলেও মানুষ কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না। অর্থাৎ উন্নয়ন করা হয়েছে; কিন্তু অদূরদর্শিতা, দলপ্রীতি ও অনৈতিকতা জড়িয়ে থাকায় সেগুলোতে উন্নয়নের ‘বরকত’ উধাও হয়ে গেছে।
দায়িত্বশীল একজন মন্ত্রী এক বক্তৃতায় স্বীকার করেছেন, দেশে এখনও তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। দেশে শিক্ষিত বেকার শতকরা ৪৭ ভাগ পার হয়েছে এবং দ্রুত এদের যথাযথ কর্মসংস্থান করা না গেলে একটি ‘শিক্ষিত বেকার যুববিপ্লব’ ঘটে যেতে পারে। এর মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন ও রাস্তায় নৈরাজ্য নিয়ে একটি ‘কিশোর বিপ্লব’সহ নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে।
এ পটভূমিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু হয় এবং জনপ্রিয় বিরোধী রাজনীতিকদের জড়ানো হয় নানা মামলায়। কিন্তু গেল ১০ বছরে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অনেক সচেতন হয়েছেন। বিবেকবান মানুষদের বিবেককে নানাভাবে রোধ করার চেষ্টা করা হলেও সবার বিবেকবোধ রুদ্ধ করা যায়নি।
দেখা যায়- বিরোধী দলগুলো যখন দিশেহারা, তখন ক্ষমতাসীন শিবিরে নমিনেশন ফরম কেনা-তোলা নিয়ে সে কী হইহুল্লোড়! একপক্ষের মারামারি করে দু’জনের প্রাণহানি এবং অন্যপক্ষের পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে!
রাজনীতি আজকাল সবচেয়ে লাভজনক প্লাটফর্ম হিসেবে রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সবকিছুতেই একটা ‘ছাড়’ পাওয়া যেতে পারে এ ভাবনা নতুন প্রজন্মের মনের মধ্যে জেঁকে বসেছে। এ আশায় নমিনেশন পেতে ব্যবসায়ী-কৃষক, মৎস্যজীবী, নায়ক-নায়িকা, খেলোয়াড়, গায়ক-গায়িকা, সাবেক আমলা-পুলিশ-সেনা, শিক্ষক, রিকশা শ্রমিক- সবার হুমড়ি খেয়ে পড়ার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। সেটা ঘটেছে প্রায় সব দলেই।
এমন অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল, রাজনীতি আর নীতির রাজা নয়। মোহ-বাসনাত্যাগী প্রকৃত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আজ প্রায় উধাও হতে বসেছে। গেল দিনগুলোতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, আবারও বুঝি সিংহভাগ অরাজনীতিকের হাতে দেশের মহান সংসদের দায়িত্বভার চলে যাচ্ছে! অনেকের এমন ধারণা হচ্ছিল, তাহলে এবার দেশের বারোটা বেজে যাবে।
এ আশঙ্কায় দেশের প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কারও কারও হৃদয়ে অশনিসংকেত শুরু হয়ে যায়। দেশের প্রয়োজনে প্রকৃত রাজনীতিকদেরই রাজনীতিতে এগিয়ে আসা উচিত। এ উপলব্ধি থেকে দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার মানসে যে ক’জন এগিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে পুরোধা ৮২ বছর বয়স্ক বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ও আইন বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন। তিনি জনগণের নিজ নিজ ভোটাধিকার সঠিকভাব প্রদানের জন্য ভোটের দিন সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত থাকা ও ‘পাহারা দেয়ার’ কথা বলেছেন।
যাতে অন্য কেউ কেন্দ্রে গিয়ে চুপিসারে আগেই তার ভোট দিয়ে ফেলতে না পারে! এ ছাড়া এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা মন্তব্য হিসেবে ভোট কেন্দ্র ‘রক্ষা’ করার কথাও বলা হয়েছে। বস্তুত ক্ষমতাসীনরা যা কল্পনাও করেননি তা-ই ঘটেছে- তাদের একজন অবহেলিত নেতার নেতৃত্বে শত প্রতিরোধ ডিঙিয়ে বাস্তবে রূপলাভ করেছে একটি বিরোধী প্রাচীর, যা নির্বাচন বর্জন ঠেকিয়ে আজ বিরোধী প্রাচীরকে মজবুত করে নির্বাচনে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করেছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে ভোট কেন্দ্র ‘রক্ষা’ করার মতো বিষয়গুলোর অবতারণা করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী এ কাজ দুটো তাদের কারোরই করার কথা নয়। এটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
আগে এ কাজের জন্য পাহারাদাররা দেশের সেবক না হয়ে একটি দলের সেবাদাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আশা করি, এবার সংসদ নির্বাচনে তাদের ভুল ভাঙবে, তারা নিরপেক্ষ থাকবেন। মূলত বর্তমান নির্বাচনী পরিবেশে কোনো দলের পক্ষে কেন্দ্র ‘পাহারা দেয়া’ বা ‘রক্ষা’ করা উভয় শব্দই একটি রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সৌন্দর্যহীনতা ও জননিরাপত্তাহীনতামূলক দুর্বল চরিত্র প্রকাশ করে। নির্বাচন কমিশন কি তাহলে আসলেই জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ? সাধারণ মানুষ তাহলে কিসে আস্থা ফিরে পাবে? এর দায়ভার ও সমাধান এ মুহূর্তে অন্তত নির্বাচন কমিশনকেই নিতে ও দিতে হবে।
ড. কামাল হোসেনের আশঙ্কাটা অমূলক নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গেল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমি বেলা ১১টার সময় একটি ভোট কেন্দ্রে আমার নিজের ভোট দিতে গিয়ে শুনি সব ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে! আমি ভেতরে ঢুকে এর প্রতিবাদ করায় হঠাৎ একজন ‘স্যার এসেছেন’ সম্বোধন করে কোত্থেকে একটি ব্যালটের গুচ্ছপাতার প্রায় শেষ হওয়া অংশ আনল। সেখানে তিনটি ব্যালট পেপার ছিল। আমাকে ভোট দেয়ার সুযোগ দিলেও আমার পরে যারা কেন্দ্রে এসেছিলেন, তারা ভোট দিতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকলেন। এক সময় হট্টগোল বেধে গেল। নিরাপত্তাহীনতা দেখে আমি দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
আমি সেদিন সকালেই এ ব্যাপারে কিছু গুঞ্জন শুনেছিলাম। কিন্তু বিষয়টা সত্যি হতে দেখে হতবাক হয়েছিলাম। পরে বিষয়টা ভোট কেন্দ্রের বাইরে এসে আরও বেশি ঘনীভূত হতে দেখেছি। সহকর্মীরা অনেকে ভোট দিতে না পেরে উপস্থিত গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছিলেন। গণমাধ্যমের লোকজনও যেন নির্বিকার।
এমনকি বিবিসির টিভি ক্যামেরাসহ কিছু লোককে সেখানে দেখেছি। পরে এর কোনো সুরাহা হয়েছে বলে কোথাও শুনিনি। এই ছিল আমার গেল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট দেয়ার অভিজ্ঞতা! তাই এমন ঘটনা যেন এবারের সংসদ নির্বাচনে কোথাও না ঘটে সে জন্য আমি নিজেও এ লেখার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের প্রতি জোর আবেদন জানাচ্ছি। এটি আমার একার অভিযোগ নয়, দেশের অনেক জায়গায় ঘটেছে বলে পরে জেনেছি।
মূলকথা, তথা মনের কথা হল- আমার ভোট আমি দিতে চাই। ভোট চলাকালীন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে কোনো সময় কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে আমি আমার ভোটাধিকার নিজ হাতে ব্যালটে সিল মেরে প্রয়োগ করতে চাই। এটা আমার সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। কোন অসভ্য, বর্বর, লোভী, অসৎ ব্যক্তি বা ব্যক্তির নিযুক্ত কেউ আমার আগে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে সেটা চুরি-জলিয়াতি করে অন্য কাউকে দিক- এমনটির বিরুদ্ধে আমার আজকের অবস্থান। ড. কামাল হোসেনও জনমনের আশঙ্কা ও আতঙ্ক থেকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই সবাইকে সাবধান ও সতর্ক থাকতে বলেছেন বলে আমার মনে হয়।
ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের উত্তর দিতে গিয়ে একজন আবেগাপ্লুত হয়ে ভোট কেন্দ্র ‘রক্ষা’ করার কথা বলেছেন। তবে এবার নির্বাচন কমিশন এ কাজ ও দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবে বলে শপথ নিয়েছে। এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠুভাবে পালন করতে দেখলেই জনগণ খুশি হবে।
এ জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সেবাদানকারী জনবলকে একটি বিশেষ দলের সেবাদাস না হয়ে দেশের সব মানুষের সেবায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে নির্ভয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই দেশের তিন কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার আওতা থেকে মুক্তি দিতে; একটি দুর্নীতিমুক্ত, মাদকমুক্ত ও শিক্ষিত-বেকারমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে একাদশ সংসদ নির্বাচন সফল হয়ে উঠুক। এর মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক অঙ্গনে টেকসই উন্নয়নের একটি মজবুত ভিত্তি গড়ে উঠুক- এটাই সবার কাম্য হওয়া উচিত।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান
fakrul@ru.ac.bd
