Logo
Logo
×

বাতায়ন

দৃঢ় পায়ে পথযাত্রার প্রত্যাশা

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দৃঢ় পায়ে পথযাত্রার প্রত্যাশা

নতুন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান। ছবি-যুগান্তর

বারবার গণতন্ত্রের পথযাত্রায় হোঁচট খেতে খেতে আমরা এখন একরকম অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। ভালোর প্রত্যাশা করার মতো মনের জোর নেই বলে মন্দের ভালোকেই আঁকড়ে ধরতে চাই। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়নি ২০১৪ সালে। তবু সবাই দশম জাতীয় সংসদ মেনে নিয়েছি। না নেয়ার যুক্তিও ছিল না।

বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল সরকারপক্ষ। কিন্তু গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন না করে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি নেতৃত্বের জোট। নির্বাচন ঠেকানোর ঘোষণা দিয়ে অরাজকতা তৈরি করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই একটি একপক্ষীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নড়বড়ে সংসদ গঠন করতে হয়েছিল।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও সরকারি দলকে সতর্ক দেখা গেছে এবার। নেতারা অংশগ্রহণমূলক ও অবিতর্কিত একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দৃঢ় করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। মানুষের প্রত্যাশাও বেড়েছিল অনেকখানি।

বিএনপি অনেকটা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন মেনে নিতে হয়েছিল। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হয়তো প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। এতে অবশ্য সরকার ও সরকারি দলের দায়িত্বও বেড়ে গিয়েছিল। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছিল সরকারকে।

এ চ্যালেঞ্জ সরকার কতটা মোকাবেলা করতে পেরেছে তা সরকারপক্ষই ভালো বলতে পারবে। নির্বাচন প্রচারকালীন সরকারপক্ষকে খুব সতর্ক মনে হয়েছিল। আবার সরকারে ফিরে আসার ব্যাপারে নিঃসংশয়ও মনে হয়নি। তাই সম্ভবত প্রথমবারের মতো আমরা একটি মার্জিত সংস্কৃতি লক্ষ করলাম।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অতীতের ভুলের জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে নির্বাচন প্রচারণা শুরু করেছিলেন। জয়ের ব্যাপারে তারা যে সুনিশ্চিত, শুরুর দিকে সে কথাও বলেননি। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা তাদের পক্ষে গণজোয়ার দেখতে পেয়েছিলেন।

কিন্তু কর্মীদের তেমন মাঠে নামাতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়নি। তবে নির্বাচনের এক-দেড় সপ্তাহ আগে থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মনোবল বাড়তে থাকে। দেশি-বিদেশি জরিপ ধারণা দেয় বিজয়ের পাল্লা মহাজোটের দিকে ভারি।

অন্যদিকে কয়েকজন বিএনপি নেতার টেলিফোন আলাপন ফাঁস হওয়ায় বোঝা গেল বিজয় সম্পর্কে তারা বেশ হতাশ। নাশকতার দিকে হাঁটতে চাইছে। পাশাপাশি দেখা গেল, বিএনপির কোনো কোনো সিনিয়র নেতার মধ্যে রেষারেষিও রয়েছে। এসব বিএনপির দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থার পরিচায়ক। এ সময় নেতৃত্বের এমন দুর্বলতা দলটির জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক ছিল।

নির্বাচন যত এগিয়ে আসছিল ততই পাল্টে যেতে থাকে প্রেক্ষাপট। তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামতে পারছিল না। অবশ্য অনেকের ঘাড়েই মামলা-হামলার ভীতি ছিল। এসব অতিক্রম করে তখনই কর্মী-সমর্থকরা মাঠে নামে যখন সাংগঠনিক কাঠামো শক্ত থাকে আর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা থাকে।

বিএনপির তৎপরতা বলতে প্রতিদিন রিজভী আহমেদের বিবৃতি পাঠেই যেন সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এ গৎবাঁধা বিবৃতি শুনতে শুনতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ গত দশ বছরে সাংগঠনিক অবস্থা আরও শক্ত করতে পেরেছিল। নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জরিপে আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।

আমরা যারা কাগজে রাজনীতি বিশ্লেষণের চেষ্টা করি, তারা নানা উপাত্ত থেকে আওয়ামী লীগের বিজয়ই দেখতে পেয়েছিলাম এবং তেমন বিশ্লেষণ নির্বাচনের আগে অনেক কলামে প্রকাশও পেয়েছিল। এ জায়গাটিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আস্থা রাখতে পারলে বিস্ময়কর বিজয়ের পর নানা বিতর্ক মাথায় নিতে হতো না।

বোধকরি আস্থা রাখতে না পারার বড় কারণ আত্মবিশ্বাসের সংকট। নির্বাচনের আগে এসে সবসময় রাজনৈতিক দলগুলো দুর্ভাবনায় পড়ে। আমাদের মনে হয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আত্মবিশ্বাস দুর্বল হওয়ার বড় কারণ পুরো শাসনকাল ধরে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির বার বাড়ন্ত আর দলীয় সন্ত্রাস চালু থাকা। ছাত্রলীগ-যুবলীগকে সুপথে আনতে না পারা। আর এসবের যোগফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া।

যেভাবেই হোক বিশাল বিজয়ের পর মন্ত্রিসভা গঠন করেছে মহাজোট সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ বিশাল বিজয়ে তাদের দায়িত্বও বেড়ে গেছে। এ সত্যটি যাতে তিনি সবসময় ধারণ করতে পারেন আমরা সেই কামনাই করি।

আমরা অতীতে লক্ষ করেছি, প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে সচেষ্ট থাকেন। এবার ইশতেহারে সবচেয়ে বড় ক্ষতটির দিকেই নজর দিয়েছেন। এটি আশার কথা। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। আমরা মনে করি, এদিকটির প্রতিই দেশবাসীর সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে।

তবে এ চ্যালেঞ্জ বর্তমান বাস্তবতায় মোকাবেলা করা খুব সহজ নয়। অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা ও দৃঢ়চিত্ততার প্রতি দেশের অধিকাংশ মানুষের আস্থা রয়েছে। নিজ গুণে এবং শ্রমে তিনি দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের উজ্জ্বল অবস্থান সুনির্দিষ্ট করতে পেরেছেন। ইতিমধ্যে ১৫ বৎসর প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। আরও পাঁচ বছরও প্রায় নিশ্চিত।

এ ক্ষেত্রেও তিনি রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন। মানুষ তাকে নির্লোভ দেশপ্রেমিকের সম্মান দেয়। একজন রাজনীতিবিদের সাফল্যের অনেকটাই তার ভাণ্ডারে জমা পড়েছে। ফলে আমরা মনে করি, সুকঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করায় তিনি দ্বিধান্বিত হবেন না।

অবশ্য দুর্নীতি কমিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা খুব সহজ নয়। রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ সহজে রক্তের আস্বাদন ছেড়ে যেতে পারে না। সে যত কাছের মানুষই হোক। এ প্রসঙ্গটি এলে আমার নানার একটি অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে ইচ্ছা হয়। মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্প।

নানা ব্রিটিশ শাসনযুগে র‌্যালি ব্রাদাসের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। অফিসের কাজে তাকে মাঝে মাঝে আসাম যেতে হতো। বনের পাশে বাড়ি, তেমন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল নানার। একবার বনে এক নিঃসঙ্গ চিতাবাঘের বাচ্চা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন সেই ভদ্রলোক।

বিড়ালের বাচ্চার মতো পেলে বড় করছিলেন। পোষ মেনে যায় চিতা শাবক। ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ ভাব। তখন কিশোর বয়স বাঘটির। বেশ নাদুসনুদুস হয়েছে। এক শীতের সকালে উঠোনে ইজিচেয়ারে শুয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন ভদ্রলোক। রোজকার মতো গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল বাঘটি।

একসময় হাত চাটতে থাকে সে। রক্তের গন্ধ পেয়ে যায়। বুনো স্বভাব জেগে ওঠে। এখন আর হাত সরাতে পারছেন না ভদ্রলোক। সরাতে গেলেই চোখ বড় বড় করে গোঙ্গিয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত উপায় না দেখে বাড়ির লোকদের ডেকে ঘর থেকে বন্দুক আনিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে মেরে ফেলতে হয়েছিল বাঘটিকে। ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিষ্ঠুর হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে চ্যালেঞ্জ আরও বড়। এ দেশের আদর্শিক রাজনীতি আর আদর্শবান পোড় খাওয়া রাজনীতিকরা তো হারিয়ে যাচ্ছেন একে একে। অর্থশক্তি আর পেশিশক্তিতে বলীয়ানরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনীতির শূন্য আসনগুলো পূরণ করছেন। এদের অনেকের স্বপ্ন থাকে রাজনীতির শক্তি কাজে লাগিয়ে অর্থশক্তি আর প্রতিপত্তি বাড়িয়ে নেয়া।

বণিক রাজনীতিকদের বড় অংশ তাদের বাণিজ্য বৃদ্ধির স্বপ্ন নিয়েই রাজনীতিতে আসেন। আমলা রাজনীতিকরা ‘লক্ষ্যে’ পৌঁছার পথঘাট ভালো চেনেন। আর এমপিরা আইনপ্রণেতা না হয়ে যখন থেকে উন্নয়ন পরিচালনার অংশীদার হন তখন থেকে তাদের অনেকের ব্যক্তি উন্নয়ন ঘটতে থাকে।

জনরব আছে এখন নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে কোটি কোটি টাকা দলীয় ফান্ডে দিতে হয়। এসব জনরবের প্রমাণ দিতে পারব না আমি। তবে সাধারণ মানুষ সবাই একথা বলবেন নির্বাচনে কিছু অর্থ খরচ তো হয়ই। এ কারণে দেশে খুব কম মানুষই আছে যারা দেখেছে নির্বাচনে নামা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য জমি-জিরাত বিক্রি করছেন।

বরঞ্চ দেখেছেন পাঁচ বছরে তাদের বিত্তবৈভব অনেক বেড়েছে। মনোনয়নপত্র দেয়ার সময় নিজেদের আমলনামা প্রকাশ করেন প্রার্থীরা। পত্রিকার ভাষ্যে জানতে পারি অনেকেরই আগের চেয়ে বিত্ত অনেকগুণ বেড়েছে। তাছাড়া ক’জন দাতা হাতেমতাই আছেন যে কোটি টাকায় মনোনয়ন নিয়ে তা সুদে-আসলে তুলে নেবেন না।

আসলে তো অলিখিত বৈধতা পেয়েই থাকেন তারা। আমরা আশা করতে চাই, বর্তমান জনপ্রতিনিধিরা এসব অস্বীকার করবেন এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দেখিয়ে দেবেন নির্লোভ জায়গা থেকে তারা জনকল্যাণে এবং দেশোন্নয়নে আত্মনিয়োগ করছেন।

তেমনটি হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতও শক্ত হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্সের প্রত্যয় কার্যকর করা সহজ হবে। অবশ্য সবাইকে চমকে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে গেল। অনেক পুরনো মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে বেশিরভাগ নবীন দিয়ে মন্ত্রিসভা সাজানো হয়েছে। হয়তো শুভ কোনো ইঙ্গিত বহন করছে এটা।

আমরা প্রত্যাশা করব, একাদশ জাতীয় সংসদ কার্যকর হবে। সরকার উন্নয়নের যে মহাযাত্রা শুরু করেছে তা যে এগিয়ে চলবে এ ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষেরই সন্দেহ নেই। কিন্তু ভয় হচ্ছে বাতির নিচের অন্ধকারকে নিয়ে। ‘আগে উন্নয়ন ও পরে গণতন্ত্রের’ ধারণার মধ্যে একটি স্থূল অদূরদর্শিতা কাজ করে।

গণতন্ত্র ভিত্তি না পেলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। জবাবদিহিতাও থাকবে না। ৫ টাকার কাজ ১৫ টাকায় করে উন্নয়ন ঠিকই দৃশ্যমান হবে; কিন্তু দুর্নীতির ১০ টাকার জের তুলতে নাভিশ্বাস হবে সাধারণ মানুষের।

আমরা আশা করব যতই চ্যালেঞ্জ থাকুক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সত্যিই যদি দুর্নীতি রোধে কঠোর হন তবে দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের সমর্থন তিনি পাবেন। ইতিহাসেও তার নাম আরও উজ্জ্বল হবে। প্রত্যাশা করব নবীন এবং সতেজ সদ্য শপথ নেয়া জনপ্রতিনিধি এবং মন্ত্রীগণ দেশপ্রেমের শক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে এ মহারণে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে দৃঢ় পদযাত্রায় অগ্রসর হবেন।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnaway7b@gmail.com

সরকার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম