বিশ্ব গ্লুকোমা সপ্তাহ : ১০-১৬ মার্চ, ২০১৯
চোখের নীরব ঘাতক
ডা. ইফতেখার মো. মুনির
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অন্ধত্ব একটি অভিশাপ। গ্লুকোমাজনিত অন্ধত্বের কোনো প্রতিকার নেই; প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। সারা বিশ্বে প্রায় ৮ কোটি লোক অন্ধ। গ্লুকোমাজনিত অন্ধ লোকের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। এর বিরাট একটি অংশ রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। গ্লুকোমা রোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ অপরিবর্তনযোগ্য অন্ধত্বের শিকার হয়, যা প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করতে পারলে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
গ্লুকোমা কী : গ্লুকোমা চোখের একটি জটিল রোগ, যাতে চোখের স্নায়ু ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি কমে যায়। এমনকি এতে একসময় রোগী অন্ধত্ববরণ করতে বাধ্য হয়। তবে সময়মতো ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করলে এ অন্ধত্ব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চোখের অভ্যন্তরীণ উচ্চচাপ এর জন্য দায়ী।
গ্লুকোমা সম্পর্কে জানা কেন জরুরি : আমাদের দেশে এবং পৃথিবীব্যাপী অন্ধত্বের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হল চোখের গ্লুকোমা। অনেক ক্ষেত্রে এ রোগের লক্ষণ রোগী বুঝতে পারার আগেই চোখের স্নায়ু অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ রোগে দৃষ্টির পরিসীমা বা ব্যাপ্তি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসে এবং কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তি অনেকদিন ঠিক থাকে বিধায় রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে অনেক দেরি করে ফেলেন। গ্লুকোমা চোখের অনিরাময়যোগ্য অন্ধত্ব তৈরি করে। তাই একবার দৃষ্টি যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। গ্লুকোমা রোগ হলে রোগীকে সারা জীবন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। অনেকেই শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকের সংস্পর্শে থাকেন না বা ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহার করেন না। ফলে এ রোগ নীরবে ক্ষতি করে অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যায়।
কেন এ রোগ হয় : এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও অদ্যাবধি চোখের উচ্চচাপই এ রোগের প্রধান কারণ বলে ধরে নেয়া হয়। তবে স্বাভাবিক চাপেও এ রোগ হতে পারে। সাধারণত চোখের উচ্চচাপ ধীরে ধীরে চোখের স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দৃষ্টিকে ব্যাহত করে। তবে কিছু রোগের সঙ্গে এ রোগের গভীর সম্পর্ক লক্ষ করা যায় এবং অন্যান্য কারণেও এ রোগ হতে পারে, যেমন পরিবারের অন্য কোনো নিকটাত্মীয়ের (মা, বাবা, দাদা, দাদি, নানা, নানি, চাচা, মামা, খালা, ফুপু) এ রোগ থাকা, ঊর্ধ্ব বয়স (চল্লিশ বা তদূর্ধ্ব), ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ, মাইগ্রেন, রাত্রিকালীন উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সেবন, স্টেরয়েড ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করা, চোখের ছানি অপারেশন না করা বা দেরি করা, চোখের অন্যান্য রোগ, জন্মগত চোখের ত্রুটি ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে কেবল চোখের উচ্চচাপই ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যা গ্লুকোমা রোগের প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।
গ্লুকোমা রোগের লক্ষণ কী : অনেক ক্ষেত্রেই রোগী এ রোগের কোনো লক্ষণ অনুধাবন করতে পারেন না। চশমা পরিবর্তনের সময় কিংবা নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার সময় হঠাৎ করেই চিকিৎসক এ রোগ নির্ণয় করে থাকেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন- ১. ঘন ঘন চশমার গ্লাস পরিবর্তন হওয়া, ২. চোখে ঝাপসা দেখা বা আলোর চারপাশে রংধনুর মতো দেখা, ৩. ঘন ঘন মাথাব্যথা বা চোখে ব্যথা হওয়া, ৪. দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমে আসা বা দৃষ্টির পারিপার্শ্বিক ব্যাপ্তি কমে আসা। অনেক সময় চলতে গিয়ে দরজার পাশে বা অন্য কোনো পথচারীর গায়ে ধাক্কা লাগা, ৫. মৃদু আলোতে কাজ করলে চোখে ব্যথা অনুভূত হওয়া, ৬. ছোট বাচ্চাদের অথবা জন্মের পর চোখের কর্নিয়া ক্রমাগত বড় হয়ে যাওয়া বা চোখের কর্নিয়া সাদা হয়ে যাওয়া, চোখ লাল হওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি।
গ্লুকোমার জন্য কাদের চক্ষু পরীক্ষা করা জরুরি : ক. যাদের পরিবারে নিকটাত্মীয়ের এ রোগ আছে, খ. চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তি, বিশেষ করে যাদের ঘন ঘন চশমা পরিবর্তন করতে হচ্ছে, গ. চোখে মাঝে মাঝে যারা ঝাপসা দেখেন বা ঘন ঘন চোখ ব্যথা বা লাল হওয়া অনুভব করেন, ঘ. যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মাইগ্রেন ইত্যাদি রোগ আছে, ঙ. যারা চোখে মাইনাস গ্লাস ব্যবহার করেন।
গ্লুকোমা রোগের চিকিৎসা : গ্লুকোমা রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব; কিন্তু নিরাময় সম্ভব নয়। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো এ রোগের চিকিৎসা সারা জীবন করে যেতে হবে। এ রোগে দৃষ্টি যতটুকু হ্রাস পেয়েছে তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে দৃষ্টি যাতে আর কমে না যায় তার জন্য আমাদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। এ রোগে প্রচলিত তিন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে : ক. ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা, খ. লেজার চিকিৎসা, গ. শল্যচিকিৎসা বা সার্জারি।
যেহেতু চোখের উচ্চচাপ এ রোগের প্রধান কারণ, তাই ওষুধের দ্বারা চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। একটি ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে একাধিক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। তদুপরি তিন মাস অন্তর অন্তর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে এ রোগের নিয়মিত কতগুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা। যেমন- দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা, চোখের চাপ পরীক্ষা, দৃষ্টি ব্যাপ্তি বা ভিজুয়াল ফিল্ড পরীক্ষা, চোখের নার্ভ পরীক্ষা।
এ রোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নিয়মিত ওষুধ ব্যবহার করা এবং সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা ও তার পরামর্শ মেনে চলা। ওষুধ ছাড়াও অন্যান্য চিকিৎসা রয়েছে যার সিদ্ধান্ত প্রয়োজনে বা সময়মতো চিকিৎসক গ্রহণ করতে পারেন।
গ্লুকোমা রোগে রোগীর করণীয় : চিকিৎসক রোগীর চক্ষু পরীক্ষা করে তার চোখের চাপের মাত্রা নির্ণয় করে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করে দেবেন তা নিয়মিত ব্যবহার করা। ২. দীর্ঘদিন একটি ওষুধ ব্যবহারে এর কার্যকারিতা কমে যেতে পারে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে; তাই নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। ৩. সময়মতো চোখের বিভিন্ন পরীক্ষা (যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে) করে দেখা যে তার গ্লুকোমা নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা। ৪. পরিবারের সবার চোখ পরীক্ষা করে গ্লুকোমা আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহার করলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে একজন গ্লুকোমা রোগী তার স্বাভাবিক দৃষ্টি নিয়ে বাকি জীবন সুন্দরভাবে অতিবাহিত করতে পারেন।
অধ্যাপক ডা. ইফতেখার মো. মুনির : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গ্লুকোমা বিভাগ, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল
