সুশীল সমাজ, সুশাসন ও রাজনীতি
মোহাম্মদ আনিসুর রহমান
প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইংরেজি ‘সিভিল সোসাইটি’ কথাটির বাংলা অর্থ হল ‘সুশীল সমাজ’। অনেকেই প্রত্যয়টিকে নাগরিক সমাজ, জনসমাজ, লোকসমাজ, বেসামরিক সমাজ ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকেন। কেউ কেউ আবার ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে সিভিল সমাজও বলে থাকেন। সামরিক শাসন ও সামরিক কাজের বিপরীতে রাষ্ট্রে, সমাজে নিরস্ত্র মানুষের কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত রূপ দিতেই মূলত সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সুশীল সমাজ শব্দটি একেক দেশের পরিপ্রেক্ষিতে একেক ধরনের ব্যঞ্জনা পেতে পারে। সুশীল সমাজের কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। তবে একটি ঐকমত্য আছে যে, এটি নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি ঐচ্ছিক সংঘ। মনে করা হয়, সুশাসিত পদ্ধতিতে পরিচালিত জনসাধারণের সংঘ রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রিকতার তুলনায় অনেক বশি কল্যাণকর। সুশীল সমাজ সাধারণত গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জনগণের অংশগ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সুশীল সমাজের মধ্যে বেসরকারি সংস্থাসমূহ, পেশাজীবী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠনসমূহ, আইনজীবী সংগঠনসমূহ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন গণমাধ্যমসমূহ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সাধারণভাবে বলা যায়, সুশীল সমাজ হল একটি সংগঠিত গোষ্ঠী, যার সদস্যরা সরকারের কাছ থেকে নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত হয়। সুশীল সমাজ ব্যক্তি ও সরকারের মধ্যে একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সুশীল সমাজ কখনও কখনও সরকার ও জনগণের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা সাধারণত বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সুশীল সমাজের রয়েছে চারটি মৌলিক উপাদান- ১. বহুত্ববাদ বা বহুদলীয় গণতন্ত্র বা উদার গণতন্ত্র, ২. জনমত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা, ৩. গোপনীয়তা ও ৪. বৈধতা।
সর্বসাধারণের উন্নতি বিধান, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সুশাসন এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য গৃহীত কার্যক্রমে স্বাধীনভাবে অথবা সরকারের সহযোগিতায় সুশীল সমাজ অংশগ্রহণ করে থাকে। সুশীল সমাজ প্রত্যয়টি মানুষের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সুশীল সমাজের অধিকারের সঙ্গে নয়। বলা হয়ে থাকে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা কিংবা প্রভাব যেখানে শেষ সেখানেই সুশীল সমাজের শুরু।
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে অনেকগুলো বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কর্মকাণ্ড পরিচালনার অনুমতি লাভ করে। এ ছাড়া অনেক স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাও গড়ে ওঠে। নাগরিক সমাজ সরকারের অবাঞ্ছিত নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত একটি সুস্থ জনজীবনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদানে মুখ্য ভূমিকা পালনের দাবি করে। এই নাগরিক সমাজই পরবর্তীকালে সুশীল সমাজ নাম ধারণ করে। সুশীল সমাজ আইন ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে বেশি সক্রিয় হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষের মধ্যে নাগরিক মনোভাব গঠন এবং তা টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও রয়েছে এ সমাজের। তবে দুঃখজনক হলেও মাঝে মাঝে মনে হয়, সুশীল সমাজ রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে কখনও কখনও কোনো কোনো ব্যক্তি, দল বা সংগঠনের অনুচর হয়ে কাজ করে, বাস্তবতা না জেনে-বুঝে মন্তব্য করে, সংবাদ সম্মেলন করে, যা আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের পরিপন্থী এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বলে প্রতীয়মান হয়। উদাহরণস্বরূপ, পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতি নিয়ে কিছু সংবাদমাধ্যম, সংগঠন, টকশোয় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবিশেষ যে ধরনের ভূমিকা রেখেছিল, তা ছিল হতাশাজনক। বিশ্বব্যাংক ও অন্যরা সেই দুর্নীতির চুল পরিমাণ প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের মতো দেশে সুশীল সমাজ শব্দটি বিপুলভাবে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে এ প্রত্যয়ের প্রকৃত অর্থ নিয়ে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুত সুশীল সমাজের ধারণা মানবসভ্যতার মতোই প্রাচীন। এ ক্ষেত্রে যেটি নতুন সেটি হচ্ছে, আমাদের দেশের পেশাজীবী মহলে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় এর ব্যাপক ব্যবহার। সুশীল সমাজ প্রত্যয়টি বর্তমানে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা দার্শনিক চিন্তার বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করার ফল। সুশীল সমাজ সংক্রান্ত প্রত্যয়গত ইতিহাসের পর্যালোচনা না করে দেশের চার দশকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টির প্রতি আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারি। সুশীল সমাজের মধ্যে রয়েছে সেই সব সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক শক্তি, যেগুলো স্বেচ্ছামূলকভাবে গড়ে উঠেছে এবং যেগুলো রাষ্ট্রের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়। এসবের মধ্যে রয়েছে পরিবার, ধর্মীয় গোষ্ঠী, ট্রেড ইউনিয়ন, প্রাইভেট কোম্পানি, রাজনৈতিক দল, মানবতাবাদী সংগঠন, পরিবেশবাদী গোষ্ঠী, নারীবাদী আন্দোলন, অভিভাবক-শিক্ষক সমিতি ইত্যাদি।
১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে সামাজিক সংগঠিত সমাজের ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের পক্ষে সব পর্যায়কে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনার অবসান অথবা সমাজতন্ত্র, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জনপ্রতিনিধির শাসন বা গণতন্ত্রের স্লোগান তুলে। এ পর্বের সংগ্রামের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে। এটা ধ্রুব সত্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হয়েছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দৃঢ়চেতা মনোভাব এবং ব্যাপক সামাজিক সংগঠিত সমাবেশের কারণে। এই সামাজিক সংগঠিত সমাবেশের সার্থকতা হল, যে কারণে তা ঘটেছিল তা প্রতিফলিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের দেয়া ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রে, যেখানে জনপ্রতিনিধির শাসন স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে।
নতুন বিশ্বব্যবস্থা, তথ্য ও যোগাযোগ বিপ্লবের কল্যাণে সুশীল সমাজের আন্দোলন বর্তমানে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে, আর সেটা প্রত্যাশিতও বটে। এটি হল বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের যোগাযোগ ও সহযোগিতার এক বিশ্ব আন্দোলন। এ আন্দোলন এখন স্থানীয় সমিতি থেকে বিশ্বসংঘ পর্যন্ত বিস্তৃত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাংলাদেশের সুশীল সমাজের অনেকে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের কিংবা আন্তর্জাতিক সংগঠনের সহযোগী হিসেবে রাজনৈতিক মঞ্চে এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের বিপরীতে অবতীর্ণ হয়। এসব দুর্বলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সুশীল সমাজ দালালবৃত্তি বা গুপ্তচরবৃত্তি না করে জনগণের অধিকার সংরক্ষণ এবং কল্যাণ নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, এটিই আমাদের সবার কাম্য। আলোচনা-সমালোচনা থাকবে, থাকতেই হবে। তবে তারও একটা সম্মানজনক মাত্রা ও সীমা থাকা উচিত। দেশ আমাদের। দেশকে নিয়ে, দেশের উন্নয়ন নিয়ে আমরা সবাই ভাবব, কথা বলব, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব এমন কর্মকাণ্ডই হোক আমাদের আগামী দিনের পথ ও পাথেয়।
মোহাম্মদ আনিসুর রহমান : পিএইচডি গবেষক, জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন
anisrahaman01@gmail.com
