|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সব মানুষই সুখী হতে চায়। পৃথিবীতে এমন কেউ কি আছে যে সুখী হতে চায় না? সুখী হতে চায় না এমন লোক পৃথিবীতে একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুখ কীভাবে আসে? এ নিয়ে ভিন্নজনের ভিন্নমত রয়েছে। অনেকেই ভাবেন- অর্থকড়ি, শিক্ষা-দীক্ষা, বিবাহ, সন্তানসন্ততি, পরিবার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি মানুষকে সুখী করতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, এসব অর্জন আসলে মানুষকে সুখী করতে পারে না। লাখ লাখ মানুষের জন্য প্রকৃত সুখ যেন সোনার হরিণ। তারা সুখ কিনতে চায়, গাড়ি, বাড়ি, অলঙ্কার, কাপড়-চোপড় বা ধন-দৌলতের মতো সুখও তাদের কাছে এক ধরনের পণ্য।
এসব প্রাপ্তি মানুষকে সাময়িকভাবে কিছুটা সুখ দিতে পারলেও প্রকৃতপক্ষে স্থায়ী সুখপ্রাপ্তির জন্য এসব অর্জন বড় ভূমিকা পালন করে না বলে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী বা চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করেন।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সুখ বৈষয়িক বা জাগতিক কোনো ব্যাপার নয়, সুখ বহুলাংশে মনস্তাত্ত্বিক বা আধ্যাত্মিক ব্যাপার। অনেক মনোবিজ্ঞানী বলেন, সুখ হল জেনেটিক বা বংশানুগতি সম্বন্ধীয়। আবার কিছু বিজ্ঞানী তাদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সূত্র ধরে বলেছেন, তারা মস্তিষ্কের এমন কিছু অংশ নির্ণয় করেছেন, যেখান থেকে সুখ নিঃসৃত হয়।
মিশিগানের হোপ কলেজের সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড মায়ার বলেন, জেনেটিক বা বংশানুগতি সম্বন্ধীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে যে যাই বলুন না কেন, সুখ অনেকাংশেই মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অনুভূতি। এটা অনেকটা মানুষের কোলেস্টেরল লেভেলের মতো, যা জেনেটিক্যালি প্রভাবান্বিত, আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষের আচার-আচরণ বা লাইফস্টাইল এবং খাদ্যাভ্যাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
সুখকে মাঝেমধ্যে এক ধরনের স্বার্থিক উদ্দেশ্য বলে মনে করা হয়। মানুষ কে বা মানুষের কী আছে তার ওপর সুখ নির্ভর করে না। মানুষ কী ভাবে বা কীভাবে ভাবে, তার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে সুখ। যার যা আছে বা যে অবস্থায় আছে তার জন্য শোকরিয়া জানিয়ে যদি প্রতিদিন শুরু করা হয়, তাতে সুখ আসবে। মানুষ আজ যা ভাবছে তার ওপর ভিত্তি করে তার ভবিষ্যতের সুখ গড়ে উঠবে।
সুতরাং কাজকর্ম ও চিন্তাধারায় পজিটিভ অ্যাপ্রোচ নিয়ে শুরু করলে জীবনে সুফল আসবে। আত্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী, মর্যাদাবান, হৃদয়বান, জ্ঞানীগুণী সৎমানুষ সাধারণত সব সময় সুখী হয়। যারা শুধু নিতে চায়, দিতে জানে না বা চায় না, তারা সুখী হয় না।
প্রত্যেক অভিজ্ঞ মানুষই বলে থাকেন, সুখপ্রাপ্তির জন্য শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষও দিনের ২৪ ঘণ্টা সুখী হয় না বা থাকে না। সুখী মানুষের জীবনেও হতাশা, দুঃখ-কষ্ট আসে। পার্থক্য হল- সুখী মানুষ হতাশা, দুঃখ-কষ্টকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে, অন্যরা পারে না।
আমাদের শরীর শুধু রক্ত মাংসে গড়া কোনো জড়বস্তু নয়, আমাদের আত্মা আছে, যা শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবেগ-অনুভূতি আমাদের শরীরের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। বস্তুজগতে কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা, মোহ, মাৎসর্য, ঈর্ষা ও প্রতিহিংসা আমাদের দুঃখকষ্ট, অশান্তি, অসুখ ও ধ্বংসের মূল কারণ।
মানুষ তার সততা, সৎকর্ম ও অকুণ্ঠ অটল সৃষ্টিকর্তাপ্রীতি দ্বারা উল্লিখিত বদগুণ থেকে নিজেকে দূরে রেখে এ পার্থিব জীবনের পরম স্বর্গসুখের স্বাদ লাভ করতে পারে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে নিয়মতান্ত্রিক স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের আদেশ দেন। আর সেই আদেশ-বিধিনিষেধ মেনে চললে জীবনে শান্তি আসবে, সুখ আসবে। সৃষ্টিকর্তার ওপর যার বিশ্বাস যত দৃঢ়, বস্তুজগতে তিনি তত সুখী।
সুস্থ, সুন্দর ও সুখী জীবনযাপনের জন্য প্রকৃতিতে হাজারও নিয়ামত রয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে এবং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাবে আমরা দিন দিন প্রাকৃতিক জীবনযাত্রা থেকে সরে এসে কৃত্রিম, অসুস্থ, ক্ষতিকর ও অসুখী জীবনধারণের প্রতি ঝুঁকে পড়েছি।
প্রাকৃতিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আজ বিশ্বজুড়ে লাখো-কোটি মানুষের শরীর, মন ও আত্মার ওপর প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অথচ প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বন করার মাধ্যমে আমরা অতি সহজে সুস্থ, সুন্দর ও সুখী জীবনের অধিকারী হতে পারি।
সুখের বিপরীত শব্দ হল অসুখ। যে সুখী নয়, সে অসুখী বা অসুস্থ। অসুখ হতে পারে শারীরিক অথবা মানসিক। শারীরিক অসুস্থতায় ভুগলেও মানুষের জীবনে সুখ থাকে না। তবুও ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে শারীরিক অসুস্থতা বহুলাংশে সারানো যায়। কিন্তু মানুষ যদি মানসিক অসুস্থতার শিকার হয়, তখন জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। কারণ মানসিক রোগ পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল রোগ।
বর্তমান বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বহু দেশে এর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এসব মানুষের সুস্থতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মহাবিভ্রান্তিতে রয়েছেন এবং হিমশিম খাচ্ছেন। ওষুধ কোম্পানি এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা হতাশা ও বিষণ্ণতাকে রোগ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন এবং ওষুধের মাধ্যমে এসব রোগ সারানোর চেষ্টা করছেন, যদিও চিকিৎসাবিজ্ঞান হতাশা বা বিষণ্ণতাকে কোনোকালেই রোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেনি।
বিষণ্ণতা কোনো রোগ নয় বলে ওষুধ এসব ক্ষেত্রে কোনো কাজ করে না। বরং শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। হার্ভার্ডের মনোবিজ্ঞানী ড্যান গিলবার্ট বলেন, তোমার সুখ তোমাকেই সংশ্লেষণ (ঝুহঃযবংরুব) করতে হবে। তোমার শরীরে মনস্তাত্ত্বিক একটি ‘ইম্মিউন সিস্টেম’ রয়েছে, যা তোমার পারিপার্শ্বিকতাকে বা তোমার বিশ্বকে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করার মাধ্যমে তোমাকে সুখী করে তুলবে।
নতুন কাপড়-চোপড় কেনা বা লটারির অগাধ টাকা অর্জন তোমার জীবনের সব দুঃখ দূর করে অনাবিল আনন্দ ও সুখ বয়ে আনবে এ ধরনের কল্পনা মানুষের চিন্তাশক্তিকে ভুল পথে পরিচালিত করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ারেন বাফেট পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ধনীদের মধ্যে অন্যতম। তার জীবন-দর্শন, কাজকর্ম, টাকা-পয়সা, সুখ-শান্তি নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। ওয়ারেন বাফেট কোনো সময় ব্যক্তিগত বিমানে চড়েন না, যদিও তিনি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিমালিকানার একটি জেট কোম্পানির মালিক। এখনও তিনি ৫০ বছর আগে কেনা তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি বাড়িতে বাস করেন এবং অনলাইন ব্রিজ খেলে তিনি অপরিসীম আনন্দ লাভ করেন।
অবিশ্বাস্য শোনালেও কথাগুলো সত্যি এবং অনুপ্রেরণাদায়ক। বিশ্বের বিশাল ধনসম্পদের মালিক পরম সুখী ওয়ারেন বাফেট মনে করেন, ধনদৌলত নয়, মনের সুখই আসল সুখ। চিরকাল তিনি বিশ্বাস করেছেন, মানুষের যা করতে ভালো লাগে এবং যা করে আনন্দ লাভ করা যায়, তাতে সাফল্য আসে, কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বাড়ে।
ওয়ারেন বাফেট বলেন, আমি সপ্তাহে ১২ ঘণ্টা অনলাইনে ব্রিজ খেলি। অনেকের কাছে এটি অতি সাধারণ বিনোদন বলে মনে হতে পারে। তবে সাধারণ অনেক কিছু আমাদের বিপুল আনন্দ ও সুখ দিতে পারে। ওয়ারেন বাফেট প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করেন না।
তিনি বলেন, আমি স্বভাবত ওসব কাজ করায় বিশ্বাস করি, যা অর্থবহ। আমার ব্যক্তিগত জীবনেও আমি অন্য ধনী ব্যক্তিরা কী করছেন তা নিয়ে পরোয়া করি না। কারও কাছে ৪০০ ফুট দীর্ঘ নৌকা আছে বলে আমার ৪০৫ ফুট দীর্ঘ নৌকা থাকতে হবে- এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণায় আমি বিশ্বাস করি না।
ধনদৌলত সম্পর্কে ওয়ারেন বাফেট বলেন, টাকা উপার্জন মানুষের জীবনে অভীষ্ট লক্ষ্য নয়, মানুষের জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যের উপজাত বা বাইপ্রডাক্ট হচ্ছে টাকা উপার্জন।
জগতে বাস করতে গেলে জাগতিক অর্জন সুখ-শান্তি আনয়নে একদম কোনো ভূমিকা পালন করে না- এ কথাটি ঠিক নয়।
সাম্প্রতিককালের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখেছেন- সব সুখের মূলে রয়েছে অর্থ। অর্থ সব সময় সুখ দিতে পারে না সত্যি; কিন্তু একজন মানুষ যখন অন্য সবার চেয়ে বেশি উপার্জন করেন, তখন তিনি ঠিকই নিজেকে সুখী মনে করেন। ভিন্নমতাবলম্বীরা বলেন, টাকা দীর্ঘ সময় সুখ এনে দিতে পারে না। তবে সাময়িকভাবে মানুষকে তৃপ্ত করে।
ছোটকাল থেকে বইপুস্তকে পড়ে এসেছি- অর্থই অনর্থের মূল’। অর্থ মানুষকে বেশি ব্যতিব্যস্ত রাখে, অর্থ মানুষের জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলে হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হয়। আমরা এ-ও পড়েছিলাম- ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত বলে নয়, নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে এ প্রবাদটি আমার বেশি পছন্দ। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে ক্ষণস্থায়ী হোক বা দীর্ঘস্থায়ী হোক, কোনো সুখই উপলব্ধি করা যায় না।
আমার দৃষ্টিতে শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষই এ বস্তুজগতে সুখ ও শান্তির জন্য যেসব উপকরণ প্রয়োজন তা অনায়াসে অর্জন করতে পারে। আমার অনেক জানাশোনা বন্ধু-বান্ধব দেখি- যখন অর্থ-প্রতিপত্তি ছিল না, তখন তারা সাধারণ জীবনযাপনের মাধ্যমে সুখ-শান্তিতে দিনাতিপাত করেছে।
এখন অর্থ-প্রতিপত্তি তাদের সারাক্ষণ অস্থির করে রাখে। রাতে ঘুমাতে পারে না, খাওয়া-দাওয়ার সময় পায় না, শারীরিক ও মানসিকভাবে তারা ভীষণ অসুস্থ। শরীর ও মনের চিকিৎসায় অর্থের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সব সুখ বিসর্জন দিতে হচ্ছে।
শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার কারণে দিন দিন তাদের জীবন অসহনীয় হয়ে পড়ছে। এদের অনেকেই আমার সঙ্গে আলাপ করে। পরামর্শ চায়। আমি বলি, শরীর ও মন ভালো রাখো- তাহলেই শুধু জীবন সুন্দর, সুখী ও অর্থবহ হয়ে উঠবে।
শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন, লোভ-লালসা পরিত্যাগ করা, অল্পে সন্তুষ্ট থাকা, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা, পরিমিত সুস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, রাতে নিরুপদ্রবভাবে ঘুমানো, আনন্দ ও সন্তুষ্টি নিয়ে কাজ করা, রাগ-বিরাগ বা আবেগপ্রবণতা পরিত্যাগ করা, বিশুদ্ধ পানি পান করা, ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীর-মনের সুস্থতা বজায় রাখা, রোগ-বিমারি থেকে মুক্ত থাকা ও দাম্পত্যজীবনে সুখী হওয়ার জন্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অর্থবহ করে গড়ে তোলা। আমাদের মনে রাখা দরকার, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং সুখী জীবনের জন্য বিবাহিত জীবনের যৌন সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আরও কিছু বাড়তি গুণাবলি অর্জন করলে মানুষ অধিকতর সুখী হতে পারে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি আত্মসমর্পণ করুন ও নিয়মিত প্রার্থনা করুন। উৎসাহব্যঞ্জক হাস্যরসে ভরপুর ভালো বইপুস্তক পড়ুন। গরিব-দুঃখী ও দুস্থ মানুষকে দান করুন এবং সেবা করুন। এতে অনেক আত্মতৃপ্তি বাড়বে।
অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। গান-বাজনা মানুষের অপরিসীম আনন্দ ও সুখের উৎস হতে পারে। নেই বলে আক্ষেপ না করে আপনার যা আছে তার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। হাসুন এবং বেশি করে হাসুন। সবাইকে নিয়ে হাসিখুশি থাকুন। তাহলে অবশ্যই আপনি সুখী ও সুস্থ থাকবেন বলে আমার বিশ্বাস।
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
drmuniruddin@gmail.com
