মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস চর্চার প্রবাদপুরুষ
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল করিম (প্রয়াত)
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজ প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, মধ্যযুগের বাংলার মুদ্রা ও শিলালিপি বিশারদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল করিমের প্রয়াণ দিবস।
এ বিশাল মানুষের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। অধ্যাপক করিমের গবেষণা অঞ্চলের সঙ্গে আমার গবেষণা অঞ্চলের সম্পর্ক ছিল। ফলে স্যারের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার জন্য ছিল জরুরি। আমি স্যারের কাছ থেকে বরাবর উদার সহযোগিতা পেয়েছি।
ভারতে গবেষণাকালীন দেখেছি ওপার বাংলার প্রখ্যাত ইতিহাসবিদরা কতটা শ্রদ্ধা করেন করিম স্যারকে। তাকে মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস চর্চায় কিংবদন্তিতুল্য পণ্ডিত মনে করেন তারা।
মুদ্রা ও শিলালিপিতে উৎকীর্ণ আরবি এবং সীমিতভাবে ফার্সি লিপিতে প্রকাশিত মুদ্রা ও শিলালিপির বক্তব্য পাঠোদ্ধার এবং মধ্যযুগের, বিশেষ করে সুলতানি বাংলার মুদ্রা ও শিলালিপি বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক করিম ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায়উন্মোচিত করতে পেরেছিলেন।
ইতিহাসের সূত্রই নিশ্চিত করছে হাজার বছরের বাংলা ছিল ঐশ্বর্যশালী। প্রাচীন বাংলায় ছয় শতকে গুপ্ত অধিকারের অবসান ঘটলে স্বাধীন বঙ্গরাজ্য এবং স্বাধীন গৌড় রাজ্যের শাসন অধ্যায় এবং পাল রাজাদের দীর্ঘ শাসনকাল ছাড়া রাজক্ষমতায় বাঙালির অবস্থান দেখা যায় না।
মধ্যযুগ এবং ঔপনিবেশিক যুগের প্রায় আটাশ বছর বাংলার রাজদণ্ড ধারণ করেছিল বিদেশি শাসক। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের কোনো শাসকই দরবারি ইতিহাস লেখাতেও ভূমিকা রাখেননি। মধ্যযুগ পর্বে দু-একটি ফার্সি ভাষায় লেখা বই পাওয়া যায় বটে, তা নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারেনি।
ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিল্লিতে রচিত গ্রন্থের ওপর ভরসা করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে মোগলপর্বের বাংলার ইতিহাস জানার কিছুটা সুযোগ থাকলেও সুলতানি পর্বের ইতিহাস রচনার তথ্য খুবই সীমাবদ্ধ।
তারপরও যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তা বিচার করে রাজনৈতিক ইতিহাস রচনা করা যতটা সহজ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চা করা ততটাই কঠিন।
এ বাস্তবতার কারণে অর্থাৎ সমকালীন তথ্য-সূত্রের অভাবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার যেটুকু ইতিহাস আধুনিক ইতিহাসবেত্তারা রচনা করেছেন, তা রাজনৈতিক ইতিহাসের গণ্ডি থেকে বেশিদূর এগোতে পারেনি। এ বাস্তবতায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনায় একটি শূন্যতাই ছিল বলা যায়।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস আসলে মানুষের ইতিহাস। রাজনৈতিক ইতিহাসের নায়ক শাসকরা হলেও সমাজ ইতিহাসে সমাজের মানুষরাই প্রধান হয়ে ওঠেন।
সমকালীন লিখিত ইতিহাসের সূত্র না থাকলে এসব মানুষের কৃতিত্ব-গাথা উন্মোচন করা কঠিন। এ অবস্থায় প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র অন্যতম প্রধান আকর, সূত্র-ভাণ্ডার হতে পারে। কিন্তু বাংলার দুর্ভাগ্য, বিশেষ করে ইংরেজ শাসনকালে পূর্ব বাংলা, পাকিস্তানি শাসনপর্বে পূর্ব পাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশে দীর্ঘকাল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রত্নতত্ত্ব চর্চা হয়নি। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে অবস্থা পাল্টাতে থাকে।
উচ্চশিক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব পাঠ ও গবেষণা শুরু হয়। এর ফলে নানা ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র গবেষকদের হাতে চলে আসতে থাকে। এভাবে বাংলার ইতিহাসের পুনর্গঠন শুরু হয়।
তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্নতত্ত্বচর্চা শুরু না হলেও নিজ পাণ্ডিত্যের গুণে জটিল প্রত্নসূত্র থেকে তথ্য উন্মোচন, পাঠ ও বিশ্লেষণ করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার পথ তৈরি করতে কোনো কোনো মেধাবী গবেষক এগিয়ে আসেন।
তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য অধ্যাপক আবদুল করিম। রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অধ্যাপক আবদুল করিম প্রত্নসূত্রের সবল দুটি মাধ্যম- মধ্যযুগের মুদ্রা ও শিলালিপির মতো জটিল সূত্রকে অধ্যয়ন পাঠ-উন্মোচন এবং বিশ্লেষণ করে তা সংবলিত করেছেন।
এসব সূত্র ব্যবহার করে অধ্যাপক আবদুল করিম একদিকে নিজে যেমন সুলতানি এবং মোগল পর্বের বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনার নতুন দিক উন্মোচন করেছেন, অন্যদিকে পরবর্তী গবেষকদের যাত্রাপথ করেছেন আলোকিত।
অধ্যাপক আবদুল করিম তার প্রথম পিএইচডি অভিসন্দর্ভ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন ‘Social History of Muslims in Bengal (down toA.D 1538)’ নামে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। গবেষণার সময়েই প্রধানত তিনি অনুভব করেন মধ্যযুগের বাংলার সমাজ ইতিহাস লিখতে হলে সমকালীন বাংলার মুদ্রা ও শিলালিপি বিশ্লেষণ জরুরি। তখন থেকেই সম্ভবত তিনি মুদ্রা ও শিলালিপি চর্চা শুরু করেন।
কারণ তিনি পিএইচডি গবেষণাসম্পন্ন করার আগেই মুদ্রাবিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। পিএইচডি গবেষণার পাশাপাশি অধ্যাপক করিম মুদ্রা নিয়ে তার গবেষণা চালিয়ে যান। এরই ফসল হিসেবে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Corpus of the Muslim Coins of Bengal (down to
A.D 1538)’।
আমরা জানি, মধ্যযুগের বিশেষত সুলতানি বাংলায় মুদ্রা ও শিলালিপিগুলোর অধিকাংশই আরবি ও ফার্সি ভাষায় উৎকীর্ণ। লিপিগুলো খোদিত হয়েছে হস্তলিখন শিল্পের কৌশল অবলম্বন করে। সুতরাং মুদ্রা ও শিলালিপিগুলো থেকে সরাসরি পাঠ গ্রহণ ও বিশ্লেষণের জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন, তা অধ্যাপক করিমের আয়ত্তাধীন ছিল।
এ সত্যটি মানতে হবে, মুদ্রা ও শিলালিপি রাজনৈতিক ইতিহাস তৈরির পথ যতটা দেখায় সমাজ ও সংস্কৃতি ততটা স্পষ্ট করে দেখায় না। কারণ এ জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের বক্তব্য-বিষয় অনেকটা নির্ধারিত বা গৎবাঁধা। তাই এসব ধরাবাঁধা বক্তব্য থেকে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের পথ ধরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করতে হয়। এ পদ্ধতি ব্যবহারের পথনির্দেশনা আমরা অধ্যাপক করিমের গ্রন্থ থেকে পাই।
মুদ্রা ও শিলালিপির সূত্র ধরে বাংলায় মুসলিম আগমনের শুরু থেকে স্বাধীন সুলতানি যুগের পতনকাল পর্যন্ত সময়ের সমাজ ও সংস্কৃতির চিত্র খুঁজে পাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা দেখা যায় উল্লিখিত করপাস গ্রন্থে। অধ্যাপক করিম পরবর্তী গবেষকদের জন্য মুদ্রাবিষয়ক আরেকটি ভাণ্ডার রেখে গিয়েছেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটির নাম ‘Cataglogue of Coins in the Cabinet of the Chit
tagong University Museum, 1976’।
বাংলার ইতিহাসের এ আকর্ষণীয় দিকগুলো অধ্যাপক করিম তার ‘Social History of Muslims in Bengal (down to A.D 1538)’ গ্রন্থে আলোচনা করতে গিয়ে গবেষকদের কৌতূহলী করে তুলেছিলেন। এ ধারার ইতিহাস রচনায় তিনি গবেষকদের জন্য অনিবার্য করে তোলেন তার মুদ্রাবিষয়ক গ্রন্থ ‘Corpus of the Muslim Coins of Bengal (down to A.D 1538)’ এবং ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘Corpus of
the Arabic and Persian Inscriptions of Bengal’ নামের গ্রন্থ।
অধ্যাপক করিম তার মেধা ও পাণ্ডিত্য দিয়ে মুদ্রা ও শিলালিপি বিশ্লেষণে অনেক বিতর্কের অবসান করার চেষ্টা করেছেন। যেমন- স্বাধীন সুলতানি বাংলা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ১৩০১ থেকে ১৩২২ সাল পর্যন্ত সিংহাসনে আসীন ছিলেন সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ। এ সুলতানের পরিচয় নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে ইতিহাসে। বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ কাহিনীতে। তিনি ফিরোজ শাহকে বলবনী বংশের লোক বলে শনাক্ত করেন। তার মতে, ফিরোজ শাহ বোগরা খানের ছেলে এবং কায়কাউসের ভাই। কিন্তু এ মত প্রতিষ্ঠা পায়নি। আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে পরবর্তী গবেষণার সূত্র ধরে প্রতিবাদ এসেছে। অবশেষে পক্ষ-বিপক্ষের সূত্রাবলি পরীক্ষা করে ড. করিম বিস্তারিত ব্যাখ্যায় একটি উপসংহারে পৌঁছার চেষ্টা করেন।
দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) বাংলার কৃতী সুলতান হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার সময় বাংলায় মুসলিম রাজ্যসীমা ব্যাপক বিস্তৃত হয়। অধ্যাপক করিম মুদ্রা প্রমাণে তার রাজ্যসীমা নির্দিষ্ট করতে পেরেছেন। এতে দেখা যায়, হুসেন শাহ তার ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই, কামরূপ, কামতা, জাজনগর, উড়িষ্যা অধিকার করেছিলেন।
মোগল অধিকারের আগেই যে স্বাধীন সুলতানি যুগে ঢাকার একাংশ একটি প্রদেশ বা বিভাগ অর্থাৎ ইকলিমের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তা অধ্যাপক করিম প্রথম লিপি প্রমাণে নিশ্চিত করেছিলেন। পুরান ঢাকার নাসওয়ালা গলিতে নির্মিত মসজিদের শিলালিপির গায়ে সমকালীন সুলতান হিসেবে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের নাম উৎকীর্ণ ছিল। একজন গভর্নর বা খাজা জাহানের কর্তৃত্বেই যে ইকলিম মুবারকাবাদ পরিচালিত হতো তা-ও এ শিলালিপি থেকে জানা সম্ভব হয়েছে। অধ্যাপক আবদুল করিমের দেখানো প্রত্নসূত্রের পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে আমি ঢাকা নগরীর প্রাচীনত্ব নিয়ে গবেষণা করার চেষ্টা করি। তাতে ঐতিহাসিক প্রমাণেই অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে ৪০০ বছর আগে মোগল প্রতিষ্ঠিত ঢাকা নগরী থেকেই ঢাকার নগরযাত্রা শুরু হয়নি। ঢাকা হাজার বছরের পুরনো শহর।
এমন অনেক উদাহরণ দেয়া সম্ভব অধ্যাপক আবদুল করিমের মুদ্রা ও শিলালিপি চর্চার মধ্য থেকে। এ মহান গবেষক নিজ পাণ্ডিত্যের মহিমায় ভবিষ্যৎ গবেষকদের পথ সৃষ্টি করে গেছেন। তিনি নিজ দক্ষতার গুণে মধ্যযুগের মুদ্রাপাঠ ও বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের পথে তৈরিতে সৃষ্ট নানা প্রশ্নের নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছেন, যা এক কথায় অনন্য। মুদ্রা ও শিলালিপি সূত্র ব্যবহার করে মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠন অধ্যাপক আবদুল করিমের দিকনির্দেশনা ছাড়া বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গবেষকদের জন্য প্রায় অসম্ভবই হতো বলা যায়।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com
