Logo
Logo
×

বাতায়ন

২২ শ্রাবণ

রবীন্দ্রনাথের গান অন্ধকারে অনুভবে

Icon

ড. আকলিমা খাতুন ইরা

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রবীন্দ্রনাথের গান অন্ধকারে অনুভবে

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত

অনেকেই বলে থাকেন, রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে হয় নিভৃতে। নির্জনে, ঘরের সব বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে একাকী। সেই নির্জন আঁধারে রবীন্দ্রনাথের বাণী তার সুর বেয়ে আমাদের অন্তর্লোকে যেন স্পষ্ট ধরা দেয়।

কবিগুরুর অনেক গানে অন্ধকারে অনুভবের এ বিষয়টি লক্ষ করা যায়। গীতবিতানের প্রেম পর্যায়ের এমনই তিনটি গান নিয়ে এ লেখার প্রয়াস।

প্রথম গান : যখন এসেছিলে অন্ধকারে/ চাঁদ ওঠেনি সিন্ধুপারে॥” গানটি কবিগুরুর ৬২ বছর বয়সের রচনা, শ্রীনিকেতনে। এখানে প্রিয় বা প্রিয়ার আগমন যখন ঘটেছে তখন প্রকৃতি অন্ধকারাচ্ছন্ন। সিন্ধুনদের পারে আকাশে তখনও চাঁদ ওঠেনি। তাহলে প্রিয় বা প্রিয়ার উপস্থিতি বোঝা গেল কী করে?

সে কি চেনা কেউ? ‘হে অজানা, তোমায় তবে/ জেনেছিলেম অনুভবে-/ গানে তোমার পরশখানি/ বেজেছিল প্রাণের তারে॥’ না, যে এসেছিল সে যেন খুব চেনা নয়, সে অজানা। তাকে দেখা হয়নি, কিন্তু তার গান শোনা গিয়েছিল। গানের ভেতর দিয়ে সে তার মনের কথাখানি প্রকাশ করেছিল।

আর তখনই প্রাণের গভীরে অনুভব করা গেল। এরপর ‘তুমি গেলে যখন একলা চলে/ চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে।’ গানের ভেতর দিয়ে যাকে জানা হল, অনুভব করা গেল, তাকে দেখার সম্ভাবনা তৈরি হল যখন আকাশে চাঁদ উঠল, জ্যোৎস্নায় আলোকিত হল সিন্ধুপার।

কিন্তু ততক্ষণে প্রিয় বা প্রিয়া ফিরে চলে গেছে। দেখা হল না তাকে, তাই পাওয়াও হল না। তবে ‘তখন দেখি, পথের কাছে/ মালা তোমার পড়ে আছে-/ বুঝেছিলেম অনুমানে এ কণ্ঠহার দিলে কারে॥’ যাবার আগে সে তার গলার প্রিয় মালাখানি রেখে গেছে।

যে মালায় রয়েছে তার স্পর্শ, তার প্রেম, তার সমর্পণ। আলোয় যাকে দেখা হল না, অন্ধকারে তাকে পাওয়া হল গভীর অনুভবে।

দ্বিতীয় গান : ‘কে দিল আবার আঘাত আমার দুয়ারে/ এ নিশীথকালে কে আসি দাঁড়ালে, খুঁজিতে আসিলে কাহারে॥’ গানটি কবি রচনা করেন শিলাইদহে বসে, তার ৩৪ বছর বয়সে। গানের সূচনায় এমন একটি ছবি মনে তৈরি হয়- যেন গভীর রাত। কোনো এক বন্ধ দ্বারে কেউ একজন করাঘাত করছে।

গৃহে কে আছে জানা নেই। কিন্তু দ্বারে যে উপস্থিত সে যেন কাউকে খুঁজতে এসেছে। আমরা সাধারণত তাই খুঁজি যা নিজের অগোচরে কোথাও হারিয়ে ফেলি বা ফেলে যাই। তাহলে কি গভীর রাতে সে ফিরে এসেছে বিশেষ কোনো জনকে খুঁজে পেতে? যাকে অজান্তে হারিয়ে ফেলেছে?

গানে এর পরের অংশে জানতে পারি গৃহে যে আছে তার অনুভূতি। ‘বহুকাল হল বসন্তদিন/ এসেছিল এক অতিথি নবীন,/ আকুল জীবন করিল মগন/ অকূল পুলকপাথারে॥’ দ্বারে করাঘাত শুনে গৃহবাসীর মনে পড়ছে অনেক আগের কোনো এক বসন্তদিনের কথা।

সেদিন সব প্রকৃতি নতুন ফুলে নতুন পাতায় বর্ণিল ছিল। পরিপূর্ণ ছিল। আনন্দময় ছিল। সেদিনের সেই গন্ধবিধুর সমীরণে এক নবীন অতিথি এসেছিল। শুধু এসেছিল নয়। বরং সেই অতিথি তার আকুল জীবনকে গভীর ভালোলাগায় মগ্ন করেছিল।

পুলকিত করেছিল অসীম আনন্দে। লক্ষণীয়, ‘বসন্তদিনে’ কথাটি অর্থাৎ দিনের আলোয় উভয়ের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। গানের পরের অংশে আমরা অতীতের বসন্তদিন থেকে আবার বর্তমানে ফিরে আসি।

‘আজি এ বরষা নিবিড়তিমির,/ ঝরোঝরো জল, জীর্ণ কুটির-/ বাদলের বায়ে প্রদীপ নিবায়ে/ জেগে বসে আছি একা রে।’ অনেকদিন কেটে গেছে। প্রকৃতিতে বর্ষা এসেছে। ঘন অন্ধকার রাতে বৃষ্টি ঝরছে।

বর্ষার বাতাসে জীর্ণ কুটিরের একমাত্র প্রদীপটি নিভে গেছে। আর সেই নিবিড় ঘন আঁধারে গৃহবাসী জেগে আছে একা। কারও কি অপেক্ষায়? ‘একা রে’ বলার ভেতর দিয়ে একাকিত্বের হাহাকার তীব্র হয়ে ওঠে।

সবশেষে দেখি- ‘অতিথি অজানা, তব গীতসুর/ লাগিতেছে কানে ভীষণমধুর-/ ভাবিতেছি মনে যাব তব সনে/ অচেনা অসীম আঁধারে॥’ আজ এই বর্ষার অন্ধকার রাতে দ্বারে যে উপস্থিত তার পরিচয় নিশ্চিত নয়।

কিন্তু তার কণ্ঠস্বর, তার গান অনেকদিন আগের মতো অকূল পুলকপাথারে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত- যাকে সম্পূর্ণ চেনা হয়নি, তার সঙ্গেই যাত্রা শুরু হবে অচেনা অসীম আঁধারে, সবটুকু চেনার জন্য।

জানার জন্য। এখানে অতিথিও যেন বসন্তদিনের স্পষ্ট আলোয় তাকে জানতে পারেনি। তাই ফিরে এসেছে বর্ষার অন্ধকার রাতে সব সত্তা দিয়ে জানার জন্য।

তৃতীয় গান : ‘দীপ নিবে গেছে মম নিশীথসমীরে,/ ধীরে ধীরে এসে তুমি যেয়ো না গো ফিরে॥’ কবিগুরু গানটি ৬০ বছর বয়সে রচনা করেন, শান্তিনিকেতনে। এই গানেও প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা নিশীথকালে। বাতাসে ঘরের প্রদীপ নিভে গেছে।

অন্ধকারে সে যেন এসে ফিরে না যায় তার জন্য গভীর আকুলতা প্রকাশিত। কিন্তু নিভে যাওয়া প্রদীপ আর জ্বালানোর প্রয়াস নেই। প্রিয়জন যেন অন্ধকারেই তাকে চিনতে পারে সে জন্য আশ্বস্ত করা হচ্ছে- ‘এ পথে যখন যাবে/ আঁধারে চিনিতে পাবে-/ রজনীগন্ধার গন্ধ ভরেছে মন্দিরে॥’

বোধকরি প্রিয়জনকে বরণ করার জন্য রজনীগন্ধা ফুল বা ফুলের মালা নিয়ে সে অপেক্ষা করছে। অন্ধকার পথে সেই ফুলের গন্ধে তার অবস্থান জানা যাবে। কিন্তু সংশয় যেন রয়েই যায়। তাই- ‘আমারে পড়িবে মনে কখন সে লাগি/ প্রহরে প্রহরে আমি গান গেয়ে জাগি।’

ফুলের গন্ধে যদি চেনা না যায় তাই গান গেয়ে অপেক্ষা। তার কণ্ঠের গান শুনলে প্রিয়জন অন্ধকারেও চিনতে পারবে এই প্রত্যাশায় গান গেয়ে সারা রাত জেগে থাকা। কিন্তু ‘ভয় পাছে শেষ রাতে/ ঘুম আসে আঁখিপাতে,/ ক্লান্ত কণ্ঠে মোর সুর ফুরায় যদি রে॥’

যার জন্য এত অধীর অপেক্ষা যদি তার আসতে বিলম্ব হয়? আর সারা রাত গান গেয়ে জাগার ক্লান্তিতে যদি শেষ রাতে ঘুম এসে যায়? গান থেমে যায়? তখন প্রিয়জন তাকে চিনবে কী করে?

এ শঙ্কা নিয়েই গানটি সমাপ্ত হয়। কিন্তু এমন আকাক্সক্ষা লক্ষ করি না যে, অন্ধকার রাত শেষে প্রভাতের প্রথম আলোয় প্রিয়জন তাকে চিনে নেবে। অন্ধকারে প্রকাশের আকুলতাই এখানে স্পষ্ট।

রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে এমন অন্ধকারে উপলব্ধির বিষয়টি লক্ষ করা যায়। আলোয় চোখের দেখা যেন অসম্পূর্ণ। পরিপূর্ণভাবে দেখার জন্য যে অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন তা যেন অন্ধকারেই মেলে।

কবিগুরুর রাজা নাটকেও এমন উপলব্ধি ব্যক্ত হয়েছে। যখন আলোয় কিছু দেখি তখন তার রূপ বা অবয়বটি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। অন্ধকারে সব সত্তা দিয়ে যা অনুভব করা যায় তার ব্যাপ্তি অসীম।

ড. আকলিমা খাতুন ইরা : রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী; সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, কুষ্টিয়া শাখা; সহযোগী অধ্যাপক, কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজ

aklimaera@gmail.com

 

ড. আকলিমা খাতুন ইরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম