|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ট্রাফিক সপ্তাহ, ট্রাফিক পক্ষ, র্যাব-পুলিশ তৎপরতা চলছে, চলছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চিহ্নিতকরণের কাজ। ওদিকে সতীর্থদের অকালমৃত্যুর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা একের পর এক সড়ক অবরোধ করছে।
কিন্তু মনে হচ্ছে, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় যে কেবল শিক্ষার্থী মারা যাচ্ছে তা নয়, তাদের ভাইবোন, বাবা-মা, শিক্ষক এবং অনেক সাধারণ মানুষও মারা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বাস, মিনিবাস, ট্রাক, ট্রাক্টরের মতো ভারী গাড়িগুলো মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্য অধিকতর দায়ী। বুয়েটের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ওইসব গাড়ির মধ্যে মিনিবাসই বেশি দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।
এটা ঠিক, আমাদের বাস, মিনিবাস, ট্রাক যাই বলি না কেন, অনেক ক্ষেত্রে জরাজীর্ণ এবং যাত্রী বহনের অযোগ্য। এ প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলছি। কয়েক মাস আগে নড়াইল থেকে ঢাকায় আসার জন্য আমি একটা বেশ নামকরা পরিবহন কোম্পানির ‘চেয়ার কোচে’র আগাম টিকিট কিনি। নির্ধারিত দিন সকাল ৯টায় নড়াইল থেকে গাড়ি ছাড়ল। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার একটু পরেই খট করে একটা শব্দ হল আর গাড়িটা একটা ঝাঁকুনি দিল। আমি গাড়ির সামনের সিটেই ছিলাম।
তবে প্রথমে শব্দ হওয়ায় আমি ড্রাইভারকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। মনে করলাম হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। যা হোক, বাস কিছুটা এগোনোর পর নবনির্মিত চিত্রা সেতুর উপর উঠল। ওঠার পর যখন সেতুর উৎরাই (স্লোপ) অতিক্রম করছে তখন গাড়ির ইঞ্জিনে ঘন ঘন খট্ খট্ শব্দ হতে লাগল। তখন আমিসহ সব যাত্রী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ড্রাইভারকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, গাড়ির অবস্থা এমন কেন, এ গাড়িতে ঢাকা যাওয়া যাবে তো ইত্যাদি।
শেষ পর্যন্ত যাত্রীদের আশঙ্কাই সত্য হল। সেতু পার হওয়ার কয়েক মিনিট পরই ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিল। বলল, ‘এ গাড়ি নিয়ে আর সামনে এগোনো যাবে না। আপনারা অন্য গাড়িতে উঠে পড়ুন।’ অবশ্য সুপারভাইজার নেমেই অন্য কোম্পানির একটি গাড়িতে যাত্রীদের অনেককে উঠতে বললেন। কোনো কোনো যাত্রী ভাড়ার টাকা ফেরত নিয়ে গাড়ি ছেড়ে চলে গেল। বলল, তাদের ইচ্ছামতো বাস, মাইক্রোবাস বা ট্যাক্সি করে গন্তব্যস্থানে পৌঁছবে। এতে বোঝা যায়, বাস মালিকরা রমরমা ব্যবসা করলেও কী ধরনের বাস রাস্তায় যাত্রী চলাচলের জন্য নামান।
আর তাদের গাড়িগুলোর বডির দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে বাসের সামনে-পেছনে-গাড়ির গায়ে অসংখ্য দুর্ঘটনার চিহ্ন। এতে বোঝা যায়, এসব ড্রাইভার যেমন বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান, মালিকরাও তেমনি গাড়ির মেরামত/রক্ষণাবেক্ষণে উদাসীন।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সড়ক দুর্ঘটনা দেখে আমার মনে হয়, সব ধরনের ট্রাফিক আইন প্রয়োগ, প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করা ছাড়াও এ মুহূর্তে আরও যেটি জরুরি তা হচ্ছে গাড়িচালকদের, বিশেষ করে বাস, মিনিবাসসহ ভারী গাড়িচালকদের যথাযথ ট্রেনিংয়ের দিকে নজর দেয়া। আমি অনেক ড্রাইভারকে প্রশ্ন করে জানতে পেরেছি, তারা কোনো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ট্রেনিং সেন্টারের প্রশিক্ষকের কাছ থেকে ট্রেনিং পাননি।
তারা সাধারণত কোনো পুরনো ড্রাইভার বা ওস্তাদের কাছে ড্রাইভিং শিখেছেন। এসব নামমাত্র ট্রেনিং সেন্টার শিক্ষাপ্রার্থীদের কেমন শিক্ষা দেয় তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। আমার স্ত্রী একবার স্থির করলেন গাড়ি চালানো শিখবেন। তিনি রাজারবাগের একটা ‘ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারে’ ভর্তি হয়ে বেশ কিছুদিন ট্রেনিং নেয়ার পর একদিন আমাকে বললেন, আমার বোধহয় ওখানে ট্রেনিং নেয়া হবে না।
কারণ জানতে চাইলে বললেন, ‘আজ আমি যখন ট্রেনিং নিচ্ছিলাম, একটা লোক রাস্তা ক্রসিংয়ের সময় একেবারে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়ল। তখন আমি গাড়ি থামিয়ে দিলাম। ট্রেইনার আমাকে বলল, ম্যাডাম গাড়ি থামালেন কেন? আমি বললাম, দেখলেন কিভাবে লোকটা গাড়ির সামনে এসে পড়ল। তখন ট্রেইনার বললেন, ম্যাডাম আপনি আপনার মতো গাড়ি চালিয়ে যাবেন, পথচারী নিজের দায়িত্বে পথ পার হবে।’
কী সাংঘাতিক কথা! যেখানে শিক্ষানবিসকে গাড়িচালনার সময় সর্বাত্মক সতর্কতা অবলম্বনের শিক্ষা দেয়ার কথা, সেখানে এই ট্রেইনার ভবিষ্যৎ চালককে বেপরোয়া হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছেন। আমার মনে হয় ট্রেইনারদের উপযুক্ত ট্রেনিং দেয়া খুবই প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং দিতে হবে ধৈর্যসহকারে। তাদের জানাতে হবে, রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় অন্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিদেশে দেখা যায় দু’জন চালক মুখোমুখি হলে একে অপরকে বলেন, আপনি আগে যান। আমাদের ড্রাইভারদের জানতে হবে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করা যাবে না। জেব্রাক্রসিংয়ের সময় সর্বাত্মক সতর্ক থাকতে হবে। ক্রসিংয়ে পথচারীদের পারাপারে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করা যাবে না।
এতক্ষণ বলা হল গাড়িচালকদের বিষয়ে। কিন্তু কেবল ড্রাইভারই কি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী? আমার মনে হয় এজন্য পথচারীরাও কম দায়ী নয়। রাস্তায় যখন দেখি কোনো নারী একটি বা একাধিক শিশু নিয়ে কোনোদিকে খেয়াল না করে বাংলামোটর, মগবাজার, কারওয়ান বাজার বা অন্য কোনো রাস্তা পার হচ্ছেন, তখন ভয়ে আমারই বুক দুরু দুরু করতে থাকে।
এখানে উল্লেখ্য যে, রাস্তার অনেক ক্রসিংয়ে ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও প্রায় কেউই সে ব্রিজ ব্যবহার করে না। যদিও পথচারীদের মধ্যে অনেকেই বোঝেন যে ব্রিজে না উঠে পায়ে হেঁটে বিপদ সংকুল রাস্তা পার হলে যে কোনো রকমের দুর্ঘটনা, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।
এখানে আমার বিশেষ করে বাংলামোটরের ফুটওভার ব্রিজটির কথা মনে পড়ছে। বেশ কয়েক বছর আগে বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ইউসুফ পাশা এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এ ফুটওভার ব্রিজটি তারই স্মৃতি বহন করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কদাচিত দু-একজন ছাড়া কেউ এই সুন্দর ব্রিজটি ব্যবহার করে নিরাপদে রাস্তা ক্রসিংয়ে উৎসাহ দেখান না। বরং শিশু, নারী ও বৃদ্ধসহ সাধারণ পথচারীরা অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পারাপার করেন।
এখানে দৃশ্যমান যে, ট্রাফিক পুলিশ উপস্থিত থাকলেও মানুষ ব্রিজ ব্যবহার করেন না অথবা ট্রাফিক পুলিশকেও পথচারীদের ব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য করতে দেখা যায় না। এছাড়া দেখা যায়, রাস্তাসংলগ্ন দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে ফুটপাতে গাড়িগুলো সমান্তরালে না রেখে খাড়াখাড়িভাবে রাখা হয়, যার ফলে গাড়ি চলার রাস্তা আরও সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং যানজটের সৃষ্টি হয়। গাড়ি যদি রাখতেই হয় তবে রাস্তার সমান্তরালে রাখতে হবে।
এটা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, কিছুদিন ধরে ট্রাফিক পুলিশ কেউ যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে সেই গাড়ির মালিককে জরিমানা করার ব্যবস্থা নিচ্ছে। বিষয়টি প্রশংসনীয় এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। তবে দেখতে হবে এ ব্যবস্থার দ্বারা কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোর লক্ষ্যে করণীয় : এক. ড্রাইভারদের সঠিকভাবে গাড়ি চালানোর ট্রেনিং দিতে হবে। তাদের ট্রেনিংয়ে অবশ্যই অন্য গাড়ি ও পথচারীদের বিষয়ে সচেতন হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। তাদের অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার শিক্ষা দিতে হবে। এজন্য ট্রেইনারদেরও ট্রেনিং দেয়ার প্রয়োজন আছে।
দুই. পথচারীদের পথচলার এবং রাস্তা ক্রস করার বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে কেবল ট্রাফিককে সমুদয় দায়িত্ব দিলে চলবে না; বরং সব সচেতন নাগরিক ও ছাত্রছাত্রীদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।
তিন. প্রয়োজনবোধে আইন কঠোর করে গাড়ির মালিকদের বাধ্য করতে হবে যাতে তারা কোনো অবস্থাতেই ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের গাড়ি রাস্তায় বের করতে না পারেন। মান্ধাতার আমলের রংচটা, টোস খাওয়া দানবসদৃশ গাড়ির পরিবর্তে সুদৃশ্য ও পরীক্ষিত গাড়ি রাস্তায় নামাতে হবে।
আরোহীদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব গাড়ির মালিকদেরও। ড্রাইভাররাও যেন বিরামহীনভাবে দীর্ঘ সময় গাড়ি না চালান সেই ব্যবস্থাও মালিকদের করতে হবে। চার. পুরনো আইন পরিবর্তন করে নতুন আইনে শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে এবং সরকার ঘোষণা দিয়েছে তা অবিলম্বে কার্যকর হবে। এটা প্রশংসনীয় এবং সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে আশা করা যায়।
মো. আজিজুলক হক : প্রেসিডেন্ট, পিডব্লিউডি রিটায়ার্ড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন; সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার, পিডব্লিউডি; সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক
