পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির ভূমিকা
ড. ফেরদৌস জামান
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
৩০ লাখ শহীদের রক্ত, তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং নয় মাসের সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সহিংসতায় এ ভূখণ্ডের রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, হাট-বাজার, ঘরবাড়ি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্রের ভেঙে পড়া শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এ মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ-১০ ধারা অনুযায়ী তিনি ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬টি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষক বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, সমাজ ও অর্থনৈতিক সংস্কারক প্রফেসর ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে।
প্রফেসর ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রদানের পরই মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ প্রদান করেন আরেক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এম ইউসুফ আলীকে। বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুটি বিভাগে বিভক্ত। এর একটি হল- মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, অন্যটি হল মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগ।
বর্তমানে দেশে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে আলাদা আলাদা আইন। বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য হল আইন সংক্রান্ত; অর্থাৎ একটি মাত্র আইন দ্বারা দেশের সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়।
পক্ষান্তরে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় নিজস্ব আইন দ্বারা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দু’ধরনের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এর একটি হল স্বায়ত্তশাসিত; অন্যটি হল সংবিধিবদ্ধ।
যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের আইন দ্বারা পরিচালিত বা পুনর্গঠিত এবং যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট আছে; সেসব বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত। এর বাইরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংবিধিবদ্ধ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
ঠন, প্রতিষ্ঠা, ধরন এবং বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছয় ভাগে বিভক্ত- জেনারেল বা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন একই সুতায় গাঁথা। সরকারের এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা বা বিভাগ দেশের উচ্চশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ দেশের পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর তথা মহামান্য রাষ্ট্রপতির সচিবালয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। কারণ বাংলাদেশের পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিদ্যমান আইন অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতিই চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাড়া অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এবং একাডেমিক দায়িত্ব পালন করে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শুধু একাডেমিক বিষয়গুলো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ দেখভাল করে। অপরদিকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তথা হাসপাতাল পরিচালনার অংশটি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় দেখভাল করে থাকে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি তথা চ্যান্সেলরের সচিবালয় হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি, প্রোভিসি এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ উল্লিখিত তিনটি পদের প্যানেল তৈরি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর অফিস আদেশ জারি করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ধারা অনুযায়ী সিনেট, সিন্ডিকেট তথা রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য নিয়োগের বিষয়টিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষভাবে সম্পন্ন করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের বিশেষজ্ঞ সদস্য (মন্ত্রণালয় তথা চ্যান্সেলর নমিনি) মনোনয়ন সংক্রান্ত যাবতীয় প্রক্রিয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পন্ন করে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্গানোগ্রামের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি, প্রবিধি এবং সংবিধি মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে।
কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি কিংবা কোষাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজস্ব জনবল দিয়ে কিংবা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভূমিকা
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে একটি ছাড়া অন্যটি অচল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ বার্ষিক বাজেট সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রেরণ করে তা অনুমোদন করিয়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করে থাকে।
শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নতুন পদ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। নতুন বিভাগ, ইন্সটিটিউট ও সেন্টার খোলার অনুমোদন প্রদান করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা ও আসবাবপত্র ক্রয়ের নিমিত্তে দেশি-বিদেশি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে অর্থের সংস্থান করতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে থাকে।
সম্মানিত শিক্ষকদের গবেষণাধর্মী পুস্তক এবং গবেষণামূলক জার্নাল প্রকাশের জন্য ‘ইউজিসি স্বর্ণপদক’ এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ প্রদানের ব্যবস্থা করে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি, প্রবিধি, সংবিধি এবং অর্গানোগ্রাম প্রণয়নে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা প্রদান করে থাকে। কোনো ভিসি, প্রোভিসি কিংবা কোষাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরপেক্ষ তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে উপস্থাপন করে থাকে।
দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ই-লাইব্রেরির সুবিধা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে।
ড. ফেরদৌস জামান : পরিচালক (প: ও উ:), ইউজিসি, ঢাকা
