Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

বাংলাদেশ কি চাল রফতানির পর্যায়ে পৌঁছেছে?

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ কি চাল রফতানির পর্যায়ে পৌঁছেছে?

ফাইল ফটো

সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সদ্য সমাপ্ত আমন মৌসুমের শুরুতেই চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দিলেও জানুয়ারি মাসের শেষদিকে সরকার সব ধরনের চাল রফতানির অনুমতি দেয়ায় বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে।

বাজারে চালের দামের, বিশেষ করে মোটা চালের দামের ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়ায় খাদ্য মন্ত্রণালয় সরকারের মোটা চাল রফতানির সিদ্ধান্তে আপত্তি জানায়।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘সামনে রোজা আসছে। একই সঙ্গে বন্যার মৌসুমও সেটি। এসব কারণে খাদ্য নিয়ে কোনো ধরনের ঝুঁকিতে যাওয়া যাবে না বলেই আমরা নতুন করে এ সময় মোটা চাল রফতানির কথা ভাবছি না’। খাদ্য মন্ত্রণালের আপত্তির কারণে আপাতত কোনো প্রতিষ্ঠানকে মোটা চাল রফতানির অনুমোদন দিচ্ছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সরকারের কার্যাবলি বণ্টন ও পরিচালনার জন্য প্রণীত ‘কার্য বিধিমালা-১৯৯৬’ অনুযায়ী, সার্বিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা এবং একটি নির্ভরযোগ্য জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা পদ্ধতি গড়ে তোলার দায়িত্বে রয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা যখন দেশ খাদ্যে উদ্বৃত্ত বলে বক্তব্য রেখে চলেছেন, তখন খাদ্য মন্ত্রণালয় মোটা চাল রফতানিতে বাদ সাধল কেন?

চাল আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬ অনুযায়ী, দেশে জাতীয় পর্যায়ে একজন সুস্থ মানুষ প্রতিদিন ৩৬৭ দশমিক ২ গ্রাম চাল খায়, যখন তার গম, শাকসবজি, মাছ, মাংস এবং ডিম গ্রহণের পরিমাণ যথাক্রমে ১৯ দশমিক ৮, ১৬৭ দশমিক ৩, ৬২ দশমিক ৬, ৭ দশমিক ৫ এবং ১৩ দশমিক ৬ গ্রাম। দেশের কমবেশি ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য চাল।

এদের কমবেশি ৮০ শতাংশ খায় মোটা চাল। আমাদের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে চাল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অতীতে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে একাধিকবার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চালের উৎপাদন হ্রাস অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করেছে। খাদ্যের অন্যান্য উপাদানের দাম বেড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলেও কোনো সরকারই চায়নি যে, চালের দাম বাড়ুক।

দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের উচ্চমূল্য যে সরকারের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে- এ বিষয়ে অতীতের সব সরকারই সজাগ থেকেছে। তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকারই চেয়েছে চালের উৎপাদন বাড়াতে এবং চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে।

যেসব কারণ বাংলাদেশ চাল রফতানির বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে সেগুলো হল- এক. গত ছয় বছরে দেশে চাল উৎপাদনের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হারে ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি।

এ সময়কালে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও অন্যান্য রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার টন, পরবর্তী অর্থবছরে (২০১৪-১৫) যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টনে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্য।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন। অর্থাৎ এ বছর চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার টনে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩ কোটি ৬৪ লাখ ৫৯ হাজার টন। সরকারিভাবে উৎপাদনের পরিমাণ প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানা যায়নি।

তবে অনুকূল আবহাওয়ার কারণে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। ওপরের বর্ণনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হল, দেশে চালের উৎপাদন এখনও স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছায়নি।

কোনো বছর উৎপাদন বেড়েছে আবার কোনো বছর কিছুটা কমেছে এবং কোনো বছর তা হয়েছে ঋণাত্মক। দেশে চাল উৎপাদনে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান থাকায় গত এক বা দু’বছরের ভালো উৎপাদন এবং বর্তমানের ১৩ লাখ টনের কিছু বেশি পরিমাণ চাল মজুদের ভিত্তিতে চাল রফতানির ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না।

দুই. বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ দেশ। প্রলয়ংকরী বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় খাদ্যশস্যসহ সার্বিক কৃষি খাত। আমরা ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেখেছি, একাধিক প্রলয়ংকরী বন্যা ও সাইক্লোন সিডর কীভাবে আমন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করেছিল।

আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৩০ লাখ ৪৫ হাজার টনের বিপরীতে উৎপাদিত আমনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৯৬ লাখ ৬২ হাজার টনে। একদিকে প্রলয়ংকরী বন্যা ও সাইক্লোন সিডরে আমন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাব এবং চাল রফতানিকারক কয়েকটি দেশ চাল রফতানি বন্ধ করে দেয়ার কারণে তৎকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নগদ অর্থ দিয়েও চাল আমদানিতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল।

আমরা আরও দেখেছি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বৃহত্তর সিলেটের হাওড়াঞ্চলে এপ্রিলের আগাম বন্যায় সরকারি হিসেবে ১০ লাখ টন বোরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে।

দেশের কমবেশি ৮০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৫০-৫২ টাকায় পৌঁছে। এক কেজি মাঝারি ও চিকন চালের দাম ছিল অনেক বেশি। এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বর্তমানে মাঠের বোরো ফসল যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?

তিন. আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুম শেষ হয়েছে। দেশের কৃষি পরিবারগুলোর সিংহভাগই ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এরা চাল বিক্রি করে না, এরা বিক্রি করে ধান। ধান উৎপাদনের জন্য নেয়া ধার-দেনা পরিশোধ এবং সংসারের প্রয়োজন মেটাতে আমন ধান কাটা মৌসুমের শুরুতেই এরা ধান বিক্রি করেছে। তাই এখন চাল রফতানি থেকে গরিব ধানচাষীদের লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

চার. দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ, গ্রামাঞ্চলে ভূমিহীন শ্রমিক, মজুর, ধান কাটার মৌসুম শেষে চাল ক্রেতায় পরিণত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীসহ ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ চাল কিনে খায়। চাল রফতানির কারণে চালের দাম বাড়লে চালকল মালিক, মজুদদার এবং স্বল্পসংখ্যক বড় ও মাঝারি কৃষক ছাড়া অন্য সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

পাঁচ. বিবিএসের হায়েস-২০১৬ মোতাবেক, জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৪৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। গ্রামাঞ্চলে খাদ্যে ব্যয় হয় ৫০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর সাধারণ মানুষ খাদ্যে যে ব্যয় করে, তার কমবেশি ৮০ শতাংশ ব্যয় হয় চালে।

একটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী মোটা চালের দাম বাড়লে ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতদরিদ্র পরিবার চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। দরিদ্র পরিবারের বেলায় এ হার ৬৬ শতাংশ। তাই মোটা চালের দাম বাড়লে এসব পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। মনে রাখা প্রয়োজন, বর্তমানে দেশে কমবেশি সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

ছয়. এটা ঠিক যে, চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত সরকারি খাতে কোনো চাল আমদানি করা হয়নি। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, ১ জুলাই, ২০১৯ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে চাল আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৮ টন। গত অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে চাল আমদানির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫ হাজার টন। সুতরাং বাংলাদেশ এখনও চাল আমদানিকারক দেশগুলোর তালিকাভুক্ত।

সবশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ এখনও মোটা চাল রফতানির পর্যায়ে পৌঁছেনি। বেশ কয়েক বছর ধরে সামান্য পরিমাণ চিকন চাল রফতানি করা হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে বিদেশ থেকে চিকন চাল আমদানিও করা হচ্ছে। তাই মোটা চাল রফতানিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আপত্তি যথার্থ হয়েছে বলতে হবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

চাল

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম