শিশু-কিশোর সংশোধনাগার কেন মৃত্যুকূপ?
ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৭৪ সালের শিশু আইন অনুযায়ী কিশোর অপরাধীদের জন্য টঙ্গীতে ‘জাতীয় সংশোধনী ইন্সটিটিউট’ স্থাপিত হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে এর কার্যক্রম চালু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল শাস্তি বিধানের পরিবর্তে শিশু-কিশোর অপরাধীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধনের পন্থা নির্ধারণ করা। প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ ছিল- শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগত অপরাধীদের ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়ন করে সমাজে খাপ খাইয়ে বসবাস উপযোগী করে নিজ নিজ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। ওদের জন্য সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, বিনোদনমূলক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা (আদব-কায়দা, ভদ্র ও মার্জিত ব্যবহার) এবং শরীর চর্চাও তাদের শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এরপর ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র তৈরি করা হয়। এখন এ ধরনের কেন্দ্রের সংখ্যা তিনটি। দুটি বালক ও একটি বালিকাদের জন্য। গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে বালক ও বালিকাদের জন্য আলাদা দুটি এবং যশোর জেলার পুলেরহাটে বালকদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এগুলোর আসন সংখ্যা ৬০০। টঙ্গীতে বালকদের জন্য ৩০০ ও কোনাবাড়িতে বালিকাদের জন্য ১৫০ এবং পুলেরহাটে বালকদের ১৫০ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ব্যবস্থা রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে নানা সমস্যার কথা শোনা গেলেও গত ১৩ আগস্ট তিন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা সবাইকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রথমে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়, সেখানে বিবদমান দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে। মারামারিতে তিনজন নিহত এবং পনেরোজন আহত হয়; কিন্তু পরবর্তী সময়ে আহত কিশোরদের বক্তব্য অনুযায়ী জানা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেধড়ক মারধরের ফলে ওরা মারা যায়। হাসপাতালে বেডে শুয়ে থাকা কয়েকজন আহত কিশোরের বক্তব্যে জানা গেছে, সেদিন কর্তৃপক্ষের দফায় দফায় মারধরের ঘটনায় ওরা হতাহত হয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ মারধরের ঘটনার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। সংবাদে একজনের বক্তব্য থেকে জানা গেছে- ‘এখন যারা হাসপাতালে তারাই এর মূল সাক্ষী। মৃত্যুপথযাত্রী কেউ মিথ্যা কথা বলে না।’ এক কিশোর বলেছে, প্রতিষ্ঠানটির ২০০ জনের চুল কেটে তার হাত ব্যথা হয়েছিল। হেড আনসার গার্ড তাকে চুল কাটতে বললে সে হাতের ব্যথার জন্য কাটতে পারবে না জানালে ওই গার্ড তাকে গালাগাল করে। এ কথা সে তার সহ-কিশোরদের জানালে কিশোররা গার্ডকে মারে। গার্ড কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে যে, কিশোররা মাদকদ্রব্য সেবন করে তাকে মেরেছে। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা ওই কিশোরদের অফিসে ডেকে নিয়ে ভয়-ভীতি দেখায় ও বেদম প্রহার করে বাইরে যেখানে-সেখানে ফেলে রাখে। এরপর একজন করে মারা গেলে তাদের হাসপাতালে আনা হয়। সেদিন রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তিনজন মারা গেলে তাদেরসহ অন্যদের হাসপাতালে নেয়া হয়।
এ ব্যাপারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ও একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করছে। নিহত কিশোর পারভেজ হাসান রাব্বির বাবা যশোর কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার আসামি ১৩ জন। ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃত প্রতিষ্ঠানটির পাঁচজন কর্মকর্তাসহ সাত বন্দিকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। পরিচালকসহ পাঁচজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ২০ আগস্ট পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আসামিরা কারাগারে থাকায় তদন্ত কমিটি তাদের বক্তব্য নিতে পারেনি।
শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী, বিভিন্ন অভিযোগে আটক শিশুরা যাতে সাধারণ কারাগারে বড়দের সংস্পর্শে এসে বড় অপরাধী না হয়ে পড়ে সেজন্য তাদের আলাদা রেখে সংশোধন করার জন্যই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। এজন্য কেন্দ্রগুলোতে প্রচলিত সেবাগুলো হল- বিভিন্ন থানায়-কারাগারে আটক শিশুদের প্রবেশন অফিসার কর্তৃক শিশু আইন অনুযায়ী বিচারপ্রাপ্তিতে সহায়তা করা। সেজন্য বিভিন্ন কারাগারে আটক শিশুকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে স্থানান্তর; শিশু আদালত কর্তৃক প্রেরিত শিশুকে গ্রহণ; রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা প্রদান; ভরণপোষণ, শিক্ষা, বৃত্তিমূলক ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান; শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক উৎকর্ষ সাধন; কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মানসিকতার উন্নয়ন; পরিচয়হীন শিশুর আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে বের করা; সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং নিয়মিত ফলোআপ করা।
পাপীকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হয়- এ দর্শন এখানে অনুসরণ করা হয়ে থাকে। খারাপ, বিপথগামী শিশু-কিশোরদের মোটিভেশনের মাধ্যমে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য তৈরি করা হয়েছে কেন্দ্রগুলো। এখানে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের চাকরি কোনো সাধারণ চাকরি নয়। এগুলো উচ্চমার্গের মানবসেবাদানের জন্য নিবেদিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কেন্দ্রগুলো এখন যে তাদের স্বকীয়তা হারিয়ে সাইনবোর্ডসর্বস্ব সাধারণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। এর করুণ পরিণতি আমরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করে আসছি।
অভিজ্ঞতায় দেখছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্মের শিক্ষার্থীরা যারা এসব প্রতিষ্ঠানে টানা ৬০ দিনের মাঠকর্মে অংশ নিয়েছে, তারা নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেছে। নীতিনির্ধারকরা সেগুলো কখনোই আমলে নেয় না। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কথা সমাজ উন্নয়ন নীতিতে থাকলেও সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদাসীন। এখানকার সেবাদানকারীদের নিয়োগ কখনোই যথাযথ সাইকোলজিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় না।
জানা গেছে, কেন্দ্রগুলোতে লেখাপড়ার বালাই নেই। শরীরচর্চা নিয়মিত হয় না। আদব-কায়দা শেখানোর মতো দক্ষ কারিগর নেই। তা না হলে একটি শিশু বা কিশোর কেন একাই ২০০ জনের চুল কেটে হাত ব্যথার শিকার হওয়ার পরও তাকে একই কাজ আরও করতে বলা হবে? তাছাড়া প্রচারিত সংবাদদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চুল কাটতে অপারগতা প্রকাশের ঘটনা থেকে তিনজনের করুণ মৃত্যু সংঘটিত হওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। মাদকদ্রব্য সেবন করে কিশোররা গার্ডকে পিটিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এত প্রশিক্ষিত আনসার থাকতে মাদকদ্রব্য কীভাবে কেন্দ্রের ভেতরে আসে? একজন পুলিশ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, ‘কেন্দ্রটির ভেতরে থাকা-খাওয়াসহ অভ্যন্তরীণ আরও নানা বিষয়ে অব্যবস্থাপনা নিয়ে কর্তৃপক্ষের ওপর আগে থেকেই অসন্তুষ্টি ছিল এ কিশোরদের। এটা একটা কারাগার। এখানে কোনো হত্যা মানে কাস্টডিয়াল ডেথ।’ একটি শিশু-কিশোর উন্নয়ন বা সংশোধনী প্রতিষ্ঠান যদি কারাগার হয়ে থাকে তাহলে সেই কারাগারে মাদকদ্রব্য ঢুকে কোন পথে, মাদকের ব্যবহারই বা হয় কোন নিয়মে?
এছাড়া, চিকিৎসার অপ্রতুলতা, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, টয়লেট পরিষ্কার করানো, খাবার কম দেয়া, মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা, যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি কেন্দ্রগুলোর ভেতর যেন নিয়মিত ঘটনা। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কোনাবাড়ির শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নিবাসী মনিরা বেগম আত্মহত্যা করে। ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি টঙ্গী কেন্দ্রের ভেতরে নিজেদের শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ২০ কিশোর। হাসপাতালে তারা জানায়, কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের নির্যাতন ও ঠিকমতো খাবার না দেয়ার প্রতিবাদে তারা এ ঘটনা ঘটায়। ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ এ কেন্দ্রে টেকনাফের নয়াপাড়া এলাকার এক কিশোরকে বলাৎকার করে চার নিবাসী। ২০১৭ সালে চট্টগ্রামের এক শিশু বলেছিল, এখানে ভাতে বাজে গন্ধ, ভাতের মধ্যে কি কোনো ওষুধ দেয়া হয়? শিশু আলামিনের মা বলেছিল- তার ছেলে জানিয়েছে, এখানে সারা সপ্তাহ ডাল-ভর্তা খাওয়ানো হয়, একদিন মুরগি দেয়া হয়। নিম্নমানের খাবার খেয়ে অনেকের পেটের অসুখ হয়।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা ও গাফিলতি এসব শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নিত্য সমস্যা। যার ফলে একজন গার্ড খুব সহজেই শিশু-কিশোরদের নির্যাতনমূলক কাজের অর্ডার করতে পারে। ওদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মাদকদ্রব্য ব্যবহারের অভিযোগ করতে সাহস করতে পারে।
দিন দিন এসব নাজুক অবস্থা হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফেলেছে। এ অবস্থা দেখে মানুষ কেন্দ্রগুলোর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে। একদিকে অনিয়ন্ত্রিত মাদক ব্যবসা ও ফায়ারওয়ালহীন ইন্টারনেটের বদৌলতে সারা দেশে শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে শোভা পাচ্ছে সহজলভ্য পর্নোগ্রাফি ও যৌনতাসংবলিত নানা অ্যাপস। অন্যদিকে প্রতারণা, হিরোইজম ও হীন রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে চলছে সন্ত্রাস। রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারীদের লাগামহীন ঘুষ-দুর্নীতির ফলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণহীনতায় যুব-কিশোর গ্যাং কালচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পাশাপাশি শিশু-কিশোর উন্নয়ন বা সংশোধন কেন্দ্রগুলো যথার্থ সেবা না দিয়ে মৃত্যুকূপ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। এজন্য দায়ী কে? তাহলে কি আমাদের দেশে শিশু-কিশোর অপরাধীদের কোনো যথার্থ সংশোধন ব্যবস্থা থাকবে না?
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর
fakrul@ru.ac.bd
