সার্বজনীন দুর্গাপূজা
দেবী দুর্গার সঙ্গে মহিষাসুর পূজা পায় কেন
স্বামী জ্ঞান প্রকাশানন্দ
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমরা দুর্গাপূজার কাঠামোয় অন্যান্য দেব-দেবীর সঙ্গে অসুরকেও দেখতে পাই। দেব-দেবীর পূজার সঙ্গে অসুরেরও পূজা হয়। প্রশ্ন এখানেই দেব-দেবীর দেবত্বের জন্য তাদের আমরা পূজা করে থাকি। কিন্তু অসুর যে আসুরিক প্রবৃত্তিতে পরিপূর্ণ, যাকে সবাই ঘৃণা করে প্রত্যাখান করে-তার পূজা করা কেন হয়, তাই এখানে আলোচনার বিষয়।
দুর্গাপূজার কাঠামোয় দেখা যায়, একটি মহিষের পেট চিরে অসুরের আগমন। এ জন্যই মনে হয় মহিষ থেকে সৃষ্ট বলে এর নাম মহিষাসুর। আবার এ-ও শোনা যায়, অসুর দুর্গাদেবীর সঙ্গে যুদ্ধের সময় নানা প্রকার মায়া অবলম্বন করে রূপ পরিবর্তন করতে পারত। সেভাবেই সে মহিষের রূপ ধারণ করেছে বলে তাকে মহিষাসুর বলা হয়।
পুরাণ মতে, মহিষাসুর হল রম্ভাসুরের পুত্র। তিনি ঘোরতর কঠিন তপস্যা করে ব্রহ্মদেবের কাছে বর লাভ করে সেই বরে বলীয়ান। তাকে স্বর্গ-মর্ত-পাতালের কোনো দেবতা পরাজিত করতে পারবে না। এহেন অবধ্য অপরাজেয় এক অসুর-যার নাম মহিষাসুর।
মহিষাসুরের মধ্যে দুটি গুণ বিরাজিত। একদিকে মহিষ অর্থাৎ পশুর গুণাবলি এবং অপরদিকে অসুরের অর্থাৎ আসুরিক গুণাবলি বিদ্যমান। পশুর গুণাবলি হল আহার, নিদ্রা আর মৈথুন। অপরদিকে অসুরের গুণাবলি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আছে-
দম্ভো দর্পোহভিমানশ্চ ক্রোধ: পারুষ্যমেবচ।
অজ্ঞানং চাভিজাতস্য পার্থ সম্পদমাসুরীম্ ॥ (১৬/৪)
অর্থাৎ, যারা আসুরিক অবস্থা লাভ করেছে তাদের মধ্যে দেখা যায়- ধর্মধ্বজিত্ব, ধন ও স্বজননিমিত্ত দর্প, অহংকার, ক্রোধ, কর্কশ ব্যবহার, কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে অবিবেক। আসুরিক ও পাশবিক-এ দুটি ভাব-শক্তিতে বলীয়ান মহিষাসুর। সে দেবী দুর্গাকে বিভিন্ন মায়াজালে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে দশদিক থেকে আক্রমণ করেছিল। তাই দেবী দুর্গাও দশ হাতে যুদ্ধ করে দুর্দমনীয় মহিষাসুরকে পরাজিত করে।
উপরোক্ত উপাখ্যানটি গভীরভাবে অনুধাবন করলে দেখা যায়, দেবতাদের ও অসুরের মধ্যে সংগ্রাম চিরকালের। যেন সু এবং কু-এর মধ্যে লড়াই। মানবের অন্তরেও দৈবশক্তির সঙ্গে আসুরিক শক্তির লড়াই সর্বদাই লেগে আছে। প্রত্যেক মানবের মধ্যে এ মহিষাসুরের গুণাবলি বিদ্যমান। মানব মন তিনটি গুণে গুণান্বিত-তমোগুণ, রজোগুণ এবং সত্ত্বগুণ।
দেখা যায়, তমোগুণের অধিকারী মানবের মধ্যে পাশবিকতা অর্থাৎ পশুর ভাবগুলো বেশি বিদ্যমান- আহার, নিদ্রা, মৈথুনই এদের সর্বস্ব। আর হিংসা-দ্বেষে পরিপূর্ণ অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতি-অসুরের মধ্যে দেখতে পাই। বস্তুত প্রবল ভোগ বাসনাপূর্ণ জীবনই অসুর। আবার রজোগুণ প্রধান মানুষে দেখা যায়, কর্মের প্রতি আসক্তি, সে কর্ম ছাড়া থাকতেই পারে না। কিন্তু সে কর্ম নিষ্কাম নয়, সকাম কর্ম। যা মানবকে মুক্তির পরিবর্তে বন্ধনের কারণ হয়। আর সত্ত্বগুণের অধিকারীর মধ্যে দেখা যায় দৈবীশক্তি বা সৎগুণাবলি।
মানবমনে আসুরিক ভাবগুলো এবং পাশবিক ভাবগুলো প্রবল থাকায় দৈবীভাবগুলো যা সত্ত্বগুণজাত তা প্রকাশিত হতে পারে না; কিন্তু সাধনার মাধ্যমে আসুরিক, পাশবিক ভাবগুলো দূরীভূত করতে পারলে দৈবভাবগুলোর স্ফুরণ ঘটে। তখনই মানুষ প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী হয়। সে ভগবান লাভের যোগ্য হয়ে মানবজীবন সার্থক করে।
দুর্গাপূজার কাঠামোয় দেখা যায়, দেবী দুর্গার পদতলে মহিষাসুরের অবস্থান। যুদ্ধের পূর্বে অসুরের ধারণা ছিল দেবী দুর্গা সামান্য অবলা নারী যা কিনা পুরুষের ভোগের বস্তু, তাই দেবী দুর্গাকে নিজের মহীয়সী করার জন্য চিন্তা করে ছিল। কিন্তু মহিষাসুর পরাজিত হয়ে উপলদ্ধি করেছেন- দেবী দুর্গা নারী হলেও ভোগের বস্তু নয়, অবলা সামান্য নয়, কামনা চরিতার্থ করার জন্য নয়। দেবী দুর্গার ত্রিশুল তার বক্ষে বিদীর্ণ হলে মহিষাসুরের মধ্যে আসুরিক এবং পাশবিক ভাব ত্রিশুলের দ্বারা বিনষ্ট হওয়ায় তার মধ্যে দৈবীভাবগুলো জেগে উঠেছে। তাই দেবী দুর্গাকে সে জগজ্জননী সম্বোধন করে উপলব্ধি করলেন-
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।(৭৩/৫)
শ্রীশ্রীচণ্ডী অর্থাৎ যে দেবী সবপ্রাণীতে মাতৃরূপে অবস্থিতা তাকে নমস্কার, তাকে নমস্কার, তাকে নমস্কার। কালিকা পুরাণ মতে, মহিষাসুর দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা করলেন- সেও যেন দেবীর সঙ্গে সর্বযজ্ঞে পূজিত হয় ও দেবীর পদসেবা করতে পারে। দেবী বলেন- পূজার যজ্ঞভাগ সব দেবতার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছে।
তাই তুমি যজ্ঞভাগ পাবে না। তবে তুমি সর্বদা পদসেবায় নিযুক্ত থাকবে এবং যেখানে আমার পূজা হবে সেখানে তুমিও পূজা পাবে। তাই দুর্গাপূজার কাঠামোয় মহিষাসুরের স্থান লাভ হয়েছে দেবী দুর্গার পদতলে। তাই তার পূজা হয়। পূজায় মহিষাসুরের ধ্যান মন্ত্রে আমরা পাই-
ওঁ কৃপাণ-চর্ম্ম-পানিঞ্চ সন্দষ্টৌষ্ঠ-পুটং তথা।
মূল-ভিন্ন-তনুং শ্যামং ধ্যায়েশ্চ মহিষাসুরম্ ।
গৃহীত- কেশপাশায় চণ্ডিকা বাম-পাণিনা।
রক্তারক্তী-কৃতাঙ্গাঁয় মহিষায় নমো নমঃ।
আবার ভক্তেরা মহিষাসুরকে প্রণাম জানায় এই মন্ত্রে-
ওঁ রুদ্রো অস্যসুররাজ ত্বং দেবাণাংদর্পনাশকঃ।
পিতুর্বর প্রার্থনয়া মহিষীগর্ভ সম্ভবঃ।
কাত্যায়ণ্যা সমং যোদ্ধং সামর্থ্যং কস্য বিদ্যতে।
কেনাসুরেণ বিধৃতঃ সমরে মধুসূদনঃ।
কেনাস্যেন বিজিত্যা জৌ ত্রিদশা সেবকী কৃতা।
মন্বন্তর ত্রয়ংকেন ভুক্তং রাজ্যমকণ্টকং।।
বভূব কস্যবা সেনা পরার্দ্ধ শত সংমিতা।
রুদ্ররূপ ধরায়াতো মহিষাসুরতে নমঃ।।
মূলত একই মায়ের দুটি সন্তান- একটি শিষ্ট আর একটি দুষ্ট অর্থাৎ একটি দেবতা, অন্যটি অসুর। মহিষাসুরের কাতর প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গা অসুরকেও নিজ সন্তান জ্ঞান করে তারই পদতলে স্থান দিয়েছেন। শ্রীমা সারদা দেবী বলতেন, সন্তানের যদি ধুলো-কাদা গায়ে লাগে মা-ই সেই ধুলো ঝেড়ে কোলে তুলে নেয়। ফলে মহিষাসুর এখন আর অসুর নয়। দেবতাদের সঙ্গে থাকার স্থান লাভ করে ভক্তের কাছে পূজা লাভের অধিকারী হল।
স্বামী জ্ঞানপ্রকাশানন্দ : অধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশন, যশোর
