শতফুল ফুটতে দাও
বাজার অর্থনীতি ও জনকল্যাণ
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে বাজার অর্থনীতি ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়ে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রাচীনকালে যখন বিনিময় ব্যবস্থা খুবই অনগ্রসর ছিল এবং মানবসমাজ গোত্রে বিভক্ত ছিল, তখন একটি গোত্রের সুনির্দিষ্ট কোনো পণ্যের চাহিদা দেখা দিলে (যা সেই গোত্রটির নেই) তা সংগ্রহ করার জন্য অন্য গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো। কারণ সেই গোত্রের ওই সুনির্দিষ্ট পণ্যটি গোত্রটির কাছে প্রচুর পরিমাণে ছিল।
আবার যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াও পণ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা ছিল। দুটি গোত্র যখন একে অপরের কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থান করত, তখন উভয় গোত্রের মানুষ নিজেদের চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য দুই গোত্রের মাঝামাঝি একটি স্থানে রাতের অন্ধকারে রেখে আসত। এভাবে একটি গোত্র অপর গোত্রের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত পণ্য নিজ নিজ ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করত।
নৃ-বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘নীরব বিনিময়’। এ ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার পর একে বলা হতো ‘নীরব বিনিময়’। সেই থেকে বাজার বিনিময় আজকের দিনের অবস্থায় পৌঁছেছে। এখন অনেক দেশেই অনলাইন মার্কেট চালু হয়েছে। কোভিড-১৯ অতিমারীর পর অনলাইনে বেচাকেনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাজার অর্থনীতি থেকে আমরা অনেক সুবিধা পাই। তা সত্ত্বেও বাজার অর্থনীতির অনেক সমালোচনা করা হয়। বাজার অর্থনীতি সামাজিক ঘনিষ্ঠতাকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। নগরায়ণ অথবা মুখোমুখি সাক্ষাতের পরিবর্তে অনলাইনে যোগাযোগ, স্কাইপে এবং ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ, অনেক দূরের মনুষের সঙ্গে যোগাযোগও অনেক সহজতর করেছে।
এ প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের ফলে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন মুহূর্তের মধ্যেই করা সম্ভব। তৎসত্ত্বেও বাজার সামাজিক সংহতিকে দুর্বল করে ফেলেছে। এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বিশ্বায়ন অথবা বর্ধিত চলমানতা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে বেশ তৎপর, অথচ নিকটবর্তী কোনো শহরের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ স্থাপন করতে এখন দেশের নাগরিকদের আত্মীয়স্বজন সে দেশের মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করা শ্রেয় মনে করে।
বাংলাদেশের অনেক নাগরিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই দীর্ঘকালের বাসিন্দা হয়ে গেছে। বিদেশের মাটিতে তাদের কেউ মারা গেলে বাংলাদেশে অবস্থানকারী আত্মীয়স্বজনকে শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য বেশ ক’দিন অপেক্ষা করতে হয়।
অনেক সময় প্রবাসে অবস্থানকারীদের মৃত্যু হলে সেখানেই কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পৃথিবীর বহু মানুষ এখন নিজ আত্মীয়স্বজন এবং নিজ শিকড় থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। ইদনীংকালে ‘Buy French’ অথবা ‘Buy American’ স্লোগান রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে; কিন্তু অস্বস্তিরও জন্ম দিয়েছে। তবে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে বিচারবিশ্লেষণ করা হচ্ছে না। ফ্রান্স ও আমেরিকার শ্রমিকদের তুলনায় চীন অথবা ভারতের শ্রমিকদের আপেক্ষিক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে না ভেবেই এ ধরনের জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতার ডালপালা বিস্তার করে চলেছে।
বাজারব্যবস্থার বিকাশের ফলে মানুষ মানুষে সম্পর্ক নামহীন ও পরিচয়হীন হয়ে পড়েছে। বাজার সম্পর্কের কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশিত। বাজার সম্পর্ক মানুষকে অর্থনৈতিক ক্ষমতাধরদের কাছ থেকে মুক্ত করেছে। বাজার ব্যক্তি অথবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাণিজ্য শর্ত চাপিয়ে দেয়ার ক্ষমতা সীমিত করে ফেলেছে। তাদের পক্ষে পণ্যের উচ্চমূল্য দাবি করা এবং উপায়হীন ভোক্তাদের ওপর মাঝারি মানের পণ্য চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
যারা বাজার বিকাশের ফলে সামাজিক ঘনিষ্ঠতা দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে দুঃখ বোধ করেন, তারা বুঝতে পারেন বাজারের জন্যই অত্যন্ত সাময়িক এবং নামহীন বাণিজ্য সম্ভব হয়েছে। বাজার অর্থনীতি উপঢৌকন অর্থনীতির (Gift Economy) বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। এখন আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুনাম এবং বারবার সম্পর্ক স্থাপন বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাগজে লেখা লেনদেনের শর্ত সংবলিত চুক্তি এখনও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অর্থাৎ বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী দুটি পক্ষ পারস্পরিক সুনামকে (Goodwill) যথেষ্ট মূল্য দেয়। সুতরাং আশ্চর্যবোধ করার কোনো কারণ নেই যে, ইন্টারনেটের বড় কোম্পানিগুলো যেমন উবার, ই’বে অথবা বুকিং ডটকম লেনদেনের অভিজ্ঞতা রেকর্ড করে রাখার ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। বাজারের হাতে সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়লেও এর বেশ কিছু ভালো দিক আছে। Gift Economyতে নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়। সমাজতত্ত্ববিদ পিয়ারে বুর্দিউ দেখেছেন দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠমন্যতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
কার্যত সহিংসার ওপর দয়ার্দ্রতার মুখোশ পরিয়ে দেয়া হয়। সাধারণভাবে বলা যায় সামাজিক বন্ধনের অনেক ভালো দিক রয়েছে। তৎসত্ত্বেও এটি হয়ে পড়তে পারে শ্বাসরুদ্ধকর এবং অনেক ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টিকারী। দৃষ্টান্তস্বরূপ কোনো কোনো ব্যক্তিকে দেখা যায় নিজ এলাকার পাউরুটি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চিরজীবন নিুমানের পাউরুটি কিনতে। এ ভোক্তা পাউরুটি ব্যবসার মালিককে অসন্তুষ্ট করতে চান না। এর বিপরীতে বাজার সম্পর্ক দেয়া-নেয়ার পরিধিকে বিস্তৃত করে। তবে এ দেয়া-নেয়ার মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
চতুর্দশ শতাব্দীর ফ্লোরেন্সের ব্যবসায়ীরা পরস্পরের মধ্যে অভূতপূর্ব আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভলতেয়ার এবং হিউম বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে সুসভ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। মন্তেস্ক ভদ্র বাণিজ্যের কথা বলেছেন। তার মতে, বাজার আমাদের শিক্ষা দেয় কী করে বিদেশিদের সঙ্গে কাজকর্ম চালিয়ে যেতে হয় এবং তাদের বুঝতে চেষ্টা করতে হয়। মার্কিন অর্থনীতিবিদ স্যাম বাউল্স একজন উত্তর মার্কসবাদী।
তিনি মার্টিন লুথার কিংয়ের সহযোগী ছিলেন। তিনি অর্থনীতিশাস্ত্রকে অন্যান্য মানবিক এবং সামাজিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি সংবাদপত্রে কলাম লিখে বাজার অর্থনীতির সুসভ্যতা নির্মাণ সম্পর্কে লিখেছেন।
যারা বাজার অর্থনীতির নেতিবাচক ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তারা তিনটি ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
প্রথমত, বাজারে যারা ক্রিয়াশীল, তারা আত্মস্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ফলে তারা অন্যদের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক ও বন্ধন সৃষ্টি করতে সক্ষম হন না। এ ব্যাপারে অ্যাডাম স্মিথের একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে। স্মিথ লিখেছেন, It is not from the benevolence of the butcher, the brewer, or the baker, that we expect our dinner, but from regard to their own interest, we address ourselves, not to their humanity but to their self love.
বাজার অর্থনীতির হৃৎপিণ্ডের মধ্যে নিহিত আছে আত্মস্বার্থ। Daron Acemoglu দেখিয়েছেন অ্যাডাম স্মিথের প্রতিধ্বনী যে ফলাফল সৃষ্টিতে এর পেছনের মানসিকতার তুলনায় ফলাফলটিই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় দুর্ভাবনার কারণ হল, বাজার নাগরিকদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দূরে ঠেলে দেয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে তাদের গ্রাম এবং বৃহত্তর পরিবার। বাজার মানুষের নিকটবর্তী সমাজের সঙ্গে যে সম্পর্ক থাকে তাকে দুর্বল করে ফেলে।
তৃতীয়ত, বাজারের ফলে মানুষ এমন সব লেনদেনের কথা ভাবতে পারে যেগুলো বাজার-সম্পর্ক না থাকলে অচিন্তনীয় হয়ে পড়ত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কথা। অথবা যৌনসেবা। এর ফলে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছুই প্রাত্যহিক বাণিজ্যিক লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।
বাজার অর্থনীতিতে যারা অংশ্রগহণ করে, তারা অবশ্যই আত্মস্বার্থের কথাই ভাবে। আত্মস্বার্থের চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করা। আস্থার সম্পর্ক স্থাপনে প্রধান বাধা হল আস্থার ক্ষয়সাধনকারী নির্জলা আত্মস্বার্থ। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানবধর্ম মানুষের স্বভাবের সামাজিক বৈশিষ্ট্য নির্মাণে ভূমিকা পালন করেছে। ফলে অর্থনৈতিক-সামাজিক বিনিময়ের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, এর ফলে আমরা পরিপূর্ণভাবে পরার্থপর প্রাণীতে পরিণত হইনি। বাজারে প্রতিযোগিতাও রয়েছে এবং সহযোগিতাও রয়েছে।
এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সব ধরনের সামাজিক বন্ধন মানুষের কল্যাণসাধন করে না। মানবসমাজের ইতিহাসে দাস ও প্রভুর মধ্যে যে রকম অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল সেটা সামাজিক বন্ধনের ভালো দৃষ্টান্ত নয়। এ ধরনের বন্ধনের অবসানই কাম্য। এছাড়া Monopsonistic (একজন বিক্রেতা এবং বহু ক্রেতা) নিয়োগকারী এবং শ্রমিকদের মধ্যে সম্পর্ক একইভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশের পাটের বাজার একসময় মুষ্টিমেয় সংখ্যক ক্রেতা নিয়ন্ত্রণ করত এবং সে বাজারে লাখ লাখ কৃষক একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করত। বাংলাদেশে কোনো পণ্য বা একাধিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলে দায়ী করা হয় সিন্ডিকেট এবং মনিটরিংয়ের অনুপস্থিতিকে। একইভাবে কৃষকরা বাজারজাতকৃত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। এ পরিস্থিতিতে সমাজে অকল্যাণের সৃষ্টি হয়। আসল সমস্যা হল বাংলাদেশে বিভিন্ন পণ্যের বাজার নিয়ে কোনো মানসম্পন্ন গবেষণা হয়নি।
আমরা আমাদের দেশে বিদ্যমান পণ্যগুলোর বাজারের প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখি না। এ সংক্রান্ত তথ্যও অপ্রতুল। নীতিনির্ধারকরা তাদের কল্পিত উপলব্ধি দিয়ে বাজারের ক্ষতিকর দিকগুলো মোকাবেলা করতে গিয়ে যেসব পলিসি প্রণয়ন করেন সেগুলোও অনেক সময় ক্ষতিকর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের বাজারের চরিত্র বোঝার জন্য গভীর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু বাজার আমাদের সঙ্গে চিরকাল থাকবে, সেহেতু বাজারের ইতিবাচক দিকগুলোকে শক্তিশালী করা এবং নেতিবাচক দিকগুলোকে মুছে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-কৌশল অব্যাহতভাবে প্রণয়ন করতে হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
