শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আলতাফ মাহমুদের ডাক নাম ঝিলু। গানের প্রতি ঝিলুর ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। পড়ালেখায় মন নেই, সারাক্ষণ গুনগুন করে গেয়ে চলে গান। ঝিলু যখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, তখন উঠানের কাঁঠাল গাছে খোদাই করে লিখে রেখেছিল ‘ঝিলু দ্য গ্রেট’। বাবা নেজাম আলী একদিন বললেন: “বেডার কাণ্ড দ্যাহো। ওরে আবাইগ্যা, গাছডার গায়ে তো লেইখা রাখছোস-‘ঝিলু দ্য গ্রেট’। গান গাইয়া কি আর গ্রেট হইতে পারবি?” ঝিলু বলল: “দেখো একদিন ঠিকই আমি ‘ঝিলু দ্য গ্রেট’ হব।” সঙ্গীতের পাশাপাশি আলতাফ মাহমুদ ছবিও আঁকতে পারতেন।
১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর আলতাফ মাহমুদ বরিশাল জেলার মুলাদী থানার অন্তর্গত পাতারচর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নেজাম আলী হাওলাদার এবং মা কদ বানুর একমাত্র পুত্রসন্তান আলতাফ মাহমুদ।
অত্যন্ত শৌখিন মানুষ ছিলেন তিনি। পোশাকের ক্ষেত্রে রঙিন ঝলমলে বিষয়টাকে এড়িয়ে চলতেন। অধিকাংশ শার্টই ছিল সাদা। শার্টের ভেতরে সাদা হাফ হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরতেন। পরনের সাদা শার্টটা সব সময় একদম ধবধবে সাদাই রাখতেন তিনি। খাবার ফেলে বা ময়লা কাদা লাগিয়ে কতটা ময়লা করতেন, সেই গল্প অজানাই সবার। তবে যে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি হাজির তার চিরাচরিত শ্বেতশুভ্র পোশাকে।
হাতে থাকত একটি রোলেক্স ঘড়ি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। অনেক অনেক চশমার ফ্রেম ছিল তার। তবে সব রংই ছিল কালো আর ফ্রেমগুলো ছিল ভারি। পায়ে চটি পরে ঢাকা শহরের অলি-গলি ঘুরে বেড়ালেও কদাচিৎ শখে জুতা পরতেন। সেটি অবশ্যই চকচকে কালি করানো থাকতে হবে। এমনই নিয়ম ছিল তার।
টাই খুব পছন্দ করতেন। আর মাঝে মাঝেই ব্লেজার পরতেন গলাবন্ধ টিশার্ট বা সোয়েটার দিয়ে। বিশেষ করে গান রেকর্ডিং সংক্রান্ত সব ছবিতে তাকে কালো ব্লেজার পরা অবস্থায় দেখা গেছে। এটি তার খুব প্রিয় পোশাক ছিল। আমার কাছে মনে হয়, বাবার এ পোশাকটা তিনি জেমস বন্ড ছবিতে নায়ককে পরতে দেখেছেন। বাবাও হয়তো সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
আর খুব প্রিয় ছিল গায়ে দেয়ার শাল বা চাদর। ঘিয়ে রঙের চাদরে হালকা কালো সুতার কাজ-এ ছিল তার প্রিয় চাদর। এটি গায়ে জড়িয়ে তিনি কত জায়গায় যে ঘুরেছেন! কত যে অনুষ্ঠানে গান করেছেন গায়ে চাদর জড়িয়ে! সময়-অসময়ের সঙ্গী ছিল তার প্রিয় ঘিয়েরঙা চাদরটা।
খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে ভেতো বাঙালি ছিলেন। সকালে তার ভাত খাওয়া চাই-ই চাই। প্রতিদিন সকালেই ভাত খেয়ে বের হয়ে যেতেন। খাবারের ক্ষেত্রে তার প্রিয় ছিল পান্তা ভাত। যেদিন তিনি পান্তা ভাত খাবেন বলেছেন, সেদিন রীতিমতো যজ্ঞ লেগে যেত বাড়িতে। কারণ, বাড়ির আদুরে এ ছেলে এমনি এমনি পান্তা ভাত খেতেন না। মচমচে করে মাছ ভাজা, ভুনা গরুর মাংস, আচার, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, নানা উপকরণ তার লাগত পান্তা খেতে। আর পান্তা তো একা খেতেন না, রাজ্যের লোক জুটিয়ে ফেলতেন খাওয়ার সময়। যে কোনো ভালো খাবারের প্রতি তার ছিল গভীর আগ্রহ। কিন্তু সেগুলো একা খাওয়া যাবে না, সঙ্গে থাকতে হতো তার বন্ধু মহলের সবার।
প্রিয় খাবারের রেস্তোরাঁ ছিল দেশবন্ধু হোটেল। রাতভর শুটিং বা কাজ শেষে দেশবন্ধুতে সকালের নাশতা খেয়ে এবং বাড়ির সবার জন্য নাশতা আর দই নিয়ে ফিরতেন। বিউটি বোর্ডিংয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। সেখানে দুপুর বেলার খাবারে ভাত-মাছ ছিল সবচেয়ে প্রিয় তার। মায়ের কাছে শুনেছি, গানের কাজে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে মায়ের জন্য রজনীগন্ধা ফুল আর দুই পিস মুরগি ভাজা নিয়ে আসতেন। মা খাবার গরম করে দিলে তিনি ভাত খেতেন আর মাকে সেই মুরগি ভাজা খেতে হতো।
মাছ কিনতে খুব পছন্দ করতেন। খুব ভোরে উঠে গাড়ি নিয়ে চলে যেতেন মাওয়া ঘাটে। ফিরতেন নানা পদের মাছ নিয়ে। গাড়ির ডিক্কি ভরে সব মাছ নিয়ে সোজা বাড়ি ফিরতেন না কখনোই। শহরের তাবৎ আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের বাড়িতে মাছ বিলিয়ে বাদবাকিটা নিয়ে বাড়ি ফেরার পরই শান্তি হতো তার।
শখের মধ্যে আরেকটা ছিল স্মোকিং পাইপ সংগ্রহ করা। কত শত রকমের পাইপ যে তার ছিল, সেটির কোনো হিসাব ছিল না। বন্ধুরা দিয়েছেন, নিজে কিনেছেন, সব মিলিয়ে পাইপের সাম্রাজ্য গড়েছিলেন তিনি। পাইপে ধোঁয়া ওঠাতে ওঠাতে পান খেতেন মাঝে মাঝে। বিশেষ করে গান সুর করার সময়।
শিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদের আরেকটি শৌখিনতা ছিল বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র; যেমন: তানপুরা থেকে আরম্ভ করে বেহালা, হারমোনিয়াম, বাঁশি, জলতরঙ্গের মতো মৌলিক যন্ত্র সংগ্রহ করা। আর অন্যদিকে লং প্লে ও রেকর্ডার, স্পুল রেকর্ডার, রেডিও, স্পিকারের মতো বিদেশি যন্ত্র জমানো। গানের কাজ করার জন্য আকাই কোম্পানির যন্ত্রপাতি ছিল তার অসম্ভব রকমের প্রিয়।
তবে আলতাফ মাহমুদের সবচেয়ে অজানা শখের কথা একদমই কখনও বলা হয়নি। অসম্ভব রকমের ভালো কাঠের কাজ করতেন তিনি। ঘরের আসবাবপত্র তৈরি করতেন নিজ হাতে। কাঠের কাজ করার সব ধরনের যন্ত্র সরঞ্জাম জমানোয় ছিল তার নেশা। বিশাল বড় বইয়ের শেলফ বানিয়েছিলেন তিনি, ঘরের এক কোণ থেকে আরেক কোণ পর্যন্ত। সেটা বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি ঠাসা ছিল লং প্লে, ডিস্ক আর প্লেয়ার দিয়ে। কুচকুচে কালো রঙা একখানা টি-টেবিল তৈরি করেছিলেন অনেক শখ করে। তার মাঝখানে দেশ-বিদেশ থেকে আনা জমানো খেলার তাসের জোকার দিয়ে সাজিয়েছিলেন। তাসের জোকার সংগ্রহ করাও তার আরেক শখ ছিল।
বাবার সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল চুল আর গোঁফের স্টাইল। ’৬৯ সালে একবার হুলিয়া হওয়ার কারণে গোঁফ, ভ্রু সব কামিয়ে ফেললেন। সে সময় মা আঁতকে উঠেছিলেন তার নতুন লুক দেখে। দু’দিন পরপর তিনি স্টাইল আর লুক বদলাতেন। চুলের স্টাইল বদলানোয় তিনি ছিলেন মাস্টার। কখনও বাবরি চুল, কখনও ছোট ছোট করে কাটা। কখনও ব্যাকব্রাশ, কখনও সিঁথি কাটতেন।
বিয়ে করার আগে একেবারেই বোহেমিয়ান ঘরানায় জীবনযাপন করেছেন তিনি। পিতার সঙ্গে অভিমান করে একটা বেহালা আর মায়ের কাঁথা নিয়ে ঢাকা চলে এসেছিলেন। নিজামুল হকের সঙ্গে অন্য এক বন্ধুর বাসার বারান্দায় রাত কাটাতেন। সে সময়ে আয়-রোজগার কিছুই ছিল না তাদের। কেরোসিন বিক্রি করে নাশতা খাবার পয়সা জোগাড় করতেন। ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রটি অসাধারণ সাফল্য বয়ে আনার পর আলতাফ মাহমুদকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মাঝ দিয়ে ধীরে ধীরে তার শৌখিনতার সাক্ষ্যগুলো ঘরে আসা-যাওয়া শুরু করেছিল।
জীবনসঙ্গীকে নিয়ে ভেসপা করে ঢাকায় ঘুরতে খুব ভালোবাসতেন। পরপর কয়েকটি চলচ্চিত্র সফল হলে খুব শখ করে কালো মরিস গাড়ি কিনে এনেছিলেন। এ গাড়ি করে স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন চলচ্চিত্রের লোকেশন স্পট খুঁজতে যেতেন। সে সময়ে যে কোনো চলচ্চিত্রের ছক, চিত্রনাট্য, কাস্টিং ও শুটিং করার সময় ক্যামেরা পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালকরা নির্দেশকের সঙ্গে কাজ শুরু করতেন। সে কারণে শুটিং চলাকালীন বাবাকে সব জায়গায় থাকতে হতো। ঢাকা থেকে দূরে শুটিং হলে মাকে নিয়ে যেতেন; সেই গাড়ি করে, যে গাড়ি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন অস্ত্র আনা-নেয়া আর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাজে লেগেছিল। অত্যন্ত ভালোবাসার বস্তু ছিল তার সেই কালো গাড়িটি।
আলতাফ মাহমুদ জন্মদিন খুব গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতেন না। তবে সারা দিন যাই করেন না কেন, দিনশেষে পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতেন বেবি আইসক্রিম পার্লারে আইসক্রিম খাওয়াতে। এটা ছিল তার জন্মদিন স্পেশাল। ’৭১-এর ৩০ আগস্ট তার অন্তর্ধান হয়েছিল। সে বছর ৩৮তম জন্মদিন পালন করা হয়নি আর। তার পরিবার প্রতি ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে আলতাফ মাহমুদের জন্য অপেক্ষা করে। ৩৮ বছর বয়সে আটকে থাকা মানুষটি প্রিয় গাড়ি করে আইসক্রিম খেতে নিয়ে যাবেন, তাই।
আজ বাবার শখ, শৌখিনতা বা প্রিয় কাজগুলোর কথা বলতে চেয়েছিলাম। হয়তো অগোছালো লেখা, তারপরও জানাতে পেরে ভালো লাগছে। এ দেশের মাটিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাবার মতো লাখো মানুষ শহীদ হয়েছেন। তারপরও সেই শোকের মাটিতে সবুজ ফসল ওঠে, বৃক্ষ বড় হয়, ফুল ফোটে। শোকের মাটির মাঝে তাদের পাতা আর পাপড়ি ঝরে পড়ে, তবুও সোনার মানুষগুলোর জন্য অবিরত হাহাকার ফুরায় না।
শাওন মাহমুদ : শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা
