Logo
Logo
×

বাতায়ন

জীবনবোধের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলুক মানুষকে

Icon

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জীবনবোধের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলুক মানুষকে

কোনো একটি বিষয়কে সব মানুষ একইভাবে দেখবে-এটি ভাবা ভুল; বরং দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভিন্নতা থাকা যৌক্তিক। একটা বই কারো কাছে জ্ঞানের উৎস। নতুন জ্ঞান সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। কারো কাছে জীবিকা নির্বাহের একটি পণ্য। এক সময় সেটি রমরমা ছিল, এখন সেখানে মন্দা চলছে। কারণ, মানুষ ক্রমাগত বইপড়া ছেড়ে ঠুনকো প্রযুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক থাকলে ঠিক আছে; কিন্তু মানুষ তো ঝুঁকছে নেতিবাচক দিকে। যে লোকটা কাগজ বিক্রি করে দিন চালায়, তার জন্য বই হলো অনেক টুকরো টুকরো মূল্যহীন কাগজ। সে বইয়ের কালো অক্ষরের শক্তির মূল্য বোঝে না, সে বোঝে তার ক্ষুধার মূল্য। আবার অধুনা বড়লোক হওয়া কারো কারো কাছে বই একটি শোপিস হিসেবে আভিজাত্যের প্রতীক। জীবনে একটি বইও হয়তো সে পড়বে না; কিন্তু বাইরের থেকে দেখে মানুষ যেন ভাবে, লোকটা বইপাগল, জ্ঞানতাপস; আরও কত কী।

পেটে তার ক্ষুধা নেই, বিদ্যাও নেই, আছে লোকদেখানো মূল্যবোধ। হয়তো প্রতিদিন বইয়ের পাতার অক্ষরগুলো কারারুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির পথ খোঁজে; কিন্তু লোকটার টাকার গরমের কাছে হেরে যায়। এখন একজন বিদ্বান মানুষের চেয়ে টাকাওয়ালা মানুষের মর্যাদা অনেক বেশি, যা এক সময় ছিল না।

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু নানাবিধ উদ্ভিদের সঙ্গে তার একটি আত্মার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। উদ্ভিদকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন, সেগুলোকে জীবনবোধ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেন। কী যেন এক অদেখাকে খুঁজে বেড়াতেন। সে অদৃশ্য অপূর্ণতা তাকে কেমন যেন তাড়িয়ে বেড়াত। আবেগও যেন কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ত তার চিন্তায়। একবার তো তিনি বলেই ফেললেন: ‘আমরা যেরূপ আহার করি, গাছও সেরূপ আহার করে...; গাছের গোড়ায় জল না দিলে গাছের আহার বন্ধ হইয়া যায় ও গাছ মরিয়া যায়।’ সে সময় মানুষ হয়তো ভেবেছিল, কী এক অদ্ভুত পাগলাটে ভাবনা।

এটাও কি সম্ভব। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় এক হয় না। আবার একজন বিজ্ঞানীর ভাবনা আরেকজন বিজ্ঞানীর ভাবনা থেকে ভিন্ন হতে পারে। জগদীশ চন্দ্র বসু উদ্ভিদের প্রাণের অস্তিত্বের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি তা প্রমাণও করেছেন। উদ্ভিদও যে তাপ, শীত, আলো, শব্দ ও অন্যান্য অনেক বাহ্যিক উদ্দীপনায় সাড়া দিতে পারে, সেটি তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। তার আবিষ্কৃত ক্রিস্কোগ্রাফ যন্ত্রের মাধ্যমে বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে উদ্ভিদের উদ্দীপনাকে তিনি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।

উদ্ভিদ নিয়ে অন্য ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আরেকজন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। লোকটার নাম লুথার বারব্যাঙ্ক। তিনি আমেরিকান উদ্ভিদবিদ, উদ্যানতত্ত্ববিদ এবং কৃষিবিজ্ঞানের পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি তার ৫৫ বছরের কর্মজীবনে ৮০০টিরও বেশি স্ট্রেন ও বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদের বিকাশ করেছেন। বারব্যাঙ্কের বিচিত্র সৃষ্টিতে ফল, ফুল, শস্য, ঘাস এবং শাকসবজিসহ নানা ধরনের উদ্ভিদ অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাগলের মতো ভালোবাসতেন উদ্ভিদকে। উদ্ভিদ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে লোকটাকে ক্যাকটাস যেন প্রশ্নবিদ্ধ করল। খুব ভোরে বাগানে পায়চারি করার সময় তার মনে প্রশ্ন জাগল, ক্যাকটাসে কেন এত কাঁটা?

এর উত্তর তিনি মনে মনে খুঁজতে লাগলেন। ক্যাকটাস সাধারণত মরুভূমি এলাকায় বেশি হয়। মরুভূমির প্রতিকূল ও রুক্ষ পরিবেশে ক্যাকটাসকে টিকে থাকতে লড়াই করতে হয়। নিজের শরীরে কাঁটা থাকে বলে সে নিজের আত্মরক্ষার যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে পারে। বারব্যাঙ্ক যে বাগানে গবেষণা করতেন, সেটা মরুভূমিতে ছিল না। অন্তর দিয়ে তিনি কাঁটা গজিয়ে ওঠার বিষয়টি বারবার ভাবতে লাগলেন। এমন একটা অনুকূল পরিবেশে কেন ক্যাকটাস ভয় পেয়ে তার শরীর কাঁটায় ভরিয়ে ফেলবে, তা তিনি কূলকিনারা করতে পারলেন না।

বাগানের অনেক ক্যাকটাসের মধ্য থেকে তিনি একটি ক্যাকটাসকে পৃথক করে ফেললেন। প্রতিদিন ভোরে তিনি ক্যাকটাসটির সান্নিধ্যে আসেন। হাতের আলতো ছোঁয়ায় সেটিকে স্পর্শ করে বলতে থাকেন: তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি খুব নিরাপদ একটা জায়গায় আছ, কেউ তোমাকে কখনো আঘাত করতে পারবে না। এ যেন মানুষের সঙ্গে উদ্ভিদের প্রেম; মনের টান। মানুষ ভাবে, লোকটা বোধহয় পাগল হয়ে গেছে; কিন্তু লুথার থেমে যাননি। প্রতিদিন তিনি ক্যাকটাসটিকে অভয় দেন, ভালোবাসার মন্ত্র শোনান, তাকে সাহস জোগান। অদ্ভুত আর অভূতপূর্ব এক ঘটনা ঘটল একদিন।

একদিন ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখলেন ক্যাকটাস থেকে নতুন পাতা বেরিয়ে এসেছে, সে পাতায় কাঁটা থাকার কথা থাকলেও তা নেই। লুথার তার ডায়েরির পাতায় লিখলেন: ‘ভালোবাসা সবাইকে নাড়া দেয়। এ ভালোবাসার ডাকে উদ্ভিদও সাড়া দেয়।’ উদ্ভিদকে নিয়ে লুথার বারব্যাঙ্ক ও জগদীশ চন্দ্র বসুর দৃষ্টিভঙ্গিতে মিলের মধ্যেও ভিন্নতা দেখা যায়। একজন উদ্ভিদের প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান দিয়েছেন, আরেকজন ভালোবাসা ও ভরসা যে উদ্ভিদকে বদলে দিতে পারে, তা আমাদের শিখিয়েছেন।

মানুষ নিজের সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে, তারও পরিবর্তন হয়। আগের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরের দৃষ্টিভঙ্গির সে পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতো। বোধশক্তি দিয়ে বোঝার মতো। সময় আর পরিস্থিতি মানুষকে সেটি শেখায়। যেমনটি ঘটেছে বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার, ব্লগার, সেলিব্রেটি ও লেখক কিরজেইডা রডরিগুয়েজের জীবনে। যদিও তার জীবনের ব্যাপ্তি ছিল খুব কম। মাত্র ৪০ বছর। ক্যানসার তার শরীরেও বাসা বাঁধে। মৃত্যুকে খুব কাছাকাছি দেখছিলেন।

গভীর অনুভূতি থেকে জন্ম নিয়েছিল জীবনবোধ। মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া একটি নোটে তিনি উল্লেখ করেন: পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের গাড়িটি আমার গ্যারেজে পড়ে আছে; কিন্তু আমাকে বসে থাকতে হয় হুইলচেয়ারে। সব রকমের ডিজাইনের কাপড়, জুতা, দামি জিনিসে আমার গৃহ ভরপুর। কিন্তু আমার শরীর ঢাকা থাকে হাসপাতালের দেওয়া সামান্য একটা চাদরে। ব্যাংকভর্তি আমার টাকা। কিন্তু সেই টাকা এখন আর আমার কোনো কাজে লাগে না।

প্রাসাদের মতো আমার গৃহ; কিন্তু আমি শুয়ে আছি হাসপাতালের টুইন সাইজের একটা বিছানায়। এক ফাইভ স্টার হোটেল থেকে আরেক ফাইভ স্টার হোটেলে আমি ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু এখন আমার সময় কাটে হাসপাতালের এক পরীক্ষাগার থেকে আরেক পরীক্ষাগারে। শত শত মানুষকে আমি অটোগ্রাফ দিয়েছি, আর আজ ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশনটাই আমার অটোগ্রাফ। আমার চুলের সাজের জন্য সাতজন বিউটিশিয়ান ছিল, আজ আমার মাথায় কোনো চুলই নেই। ব্যক্তিগত জেটে আমি যেখানে খুশি সেখানেই উড়ে যেতে পারতাম। কিন্তু হাসপাতালের বারান্দায় যেতেও এখন আমার দুজন মানুষের সাহায্য নিতে হয়।

পৃথিবীব্যাপী ভরপুর নানা খাবার থাকলেও দিনে দুটি পিল আর রাতে কয়েক ফোঁটা স্যালাইন আমার খাবার। এই গৃহ, এই গাড়ি, এই জেট, এই আসবাবপত্র, এত এত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, এত সুনাম আর এত খ্যাতি-এগুলোর কোনো কিছুই আমার আর কোনো কাজে আসছে না। এগুলোর কোনো কিছুই আমাকে একটু আরাম দিতে পারছে না। শুধু দিতে পারছে প্রিয় কিছু মানুষের মুখ আর তাদের স্পর্শ।’ এটাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। দৃষ্টিভঙ্গির শক্তি।

এখন মানুষ দৃষ্টিভঙ্গিই গড়ে তুলতে পারছে না। দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার মতো শিক্ষা, মূল্যবোধ, মেধা, মননশীলতা ও জীবনাচরণের মতো বিষয়গুলো যেন একটি মানবিক সংকটে পতিত হয়েছে। সবখানে একটি অসম প্রতিযোগিতা। নিজের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নিজের বিশ্বাসঘাতকতা ও সমঝোতা। সেখানে জীবনবোধের চেয়ে নিজের স্বার্থের প্রভাবটা অনেক বেশি থাকায় তা মানুষের মধ্যে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে দিচ্ছে না। তবে সবকিছুই তো অচলায়তন ভেঙে একদিন বেরিয়ে আসে।

মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়। জীবনের শেষ পেরেকটাও হয়তো সেটায় গেঁথে দেওয়া হয়। তাতেও মৃদু হৃদস্পন্দন থেকে যায়। মানুষ সেই মৃতপ্রায় জীবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে একদিন দৃষ্টিভঙ্গির শক্তি নিয়ে ফিরে আসার সাহস পায়। সেটা হয়তো এখন স্বপ্ন; কিন্তু স্বপ্নই তো বাস্তব হয়। মানুষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মানুষ হয়ে উঠে এবং যা আমাদের জানিয়ে দেয়-দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেই মানুষ হয়; দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে মানুষ হয় না।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

asadzmn2014@yahoo.com

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী দৃষ্টিভঙ্গি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম