Logo
Logo
×

বাতায়ন

প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে

Icon

সালাহ্উদ্দিন নাগরী

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে

প্লাস্টিক, প্লাস্টিকজাত পণ্য যেমন- টুথব্রাশ, চিরুনি, চশমা, জুতা, স্যান্ডেল, মোবাইল সেট, কলম, স্যানিটাইজারের কনটেইনার, খনিজ পানির বোতল, করোনাকালে ফেসশিল্ড, মাস্ক- এসব পণ্য আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।

এসব ছাড়া জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শুধু ভ্রমণকালেই যে পাতলা প্লাস্টিকের গ্লাসে পানি, চা, কফি বা গরম কিছু খাওয়া হচ্ছে তা নয়; ক্রোকারিজ, কাটলারিজ ধোয়ামোছার ভয়ে এখন বাসাবাড়িতে প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ছে। সব দেশের সব এয়ার ক্র্যাফটে প্লাস্টিক প্যাকেটে গরম খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।

হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে সরবরাহকৃত রেডিমেড খাবারের পুরোটাই পলিথিন ও প্লাস্টিকজাত সামগ্রীর সাহায্যে প্যাকেট করা হচ্ছে। মিনারেল ওয়াটারের বোতলকে যে কতবার রিফিল করে ব্যবহার করা হচ্ছে তার ইয়াত্তা নেই। দীর্ঘদিন রিফিল করে পানি পানের পর রং নষ্ট হয়ে যাওয়া বোতলগুলোয় ঘরে তৈরি ফলের জুস, মধু, সরিষার তেল রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর। বাসাবাড়িতে মসলাপাতিসহ রান্নার বিভিন্ন সামগ্রী প্লাস্টিক কৌটায় আবদ্ধ। বালতি, ড্রাম, পানি সংরক্ষণের ওভারহেড ট্যাংকি, পিভিসি পাইপ, পানির ট্যাপ ইত্যাদি প্লাস্টিকের তৈরি।

এসব থেকে অতি ক্ষুদ্র কণা প্রতিদিন মানুষের পেটে যাচ্ছে। এতে ক্যান্সার, কিডনির সমস্যাসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগের ঝুঁকি বাড়চ্ছে। শুধু কি স্বাস্থ্যঝুঁকি? প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের যথেচ্ছ ব্যবহারে পরিবেশ বিষাক্ত ও দূষিত হচ্ছে। এসব কথা আমরা সবাই জানি, তারপরও এর করাল গ্রাস থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। বরং ব্যবহারবান্ধব এবং দামে কম হওয়ায় প্লাস্টিকজাত পণ্য দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং নিত্যনতুন এসব পণ্য প্রতিনিয়ত বাজার দখল করছে। জীবন ধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

গবেষণায় জানা যায়, প্রতি বছর মাথাপিছু প্রায় ৫ কেজি প্লাস্টিক দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হয়। পত্রিকার খবর মতে, বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের। আর প্লাস্টিক উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। ২০ লাখেরও বেশি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত। ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখ পলিব্যাগ পরিত্যক্ত হয়ে তা পুকুর, ডোবা, নদী-নালা ও সাগরে গিয়ে জমা হচ্ছে। কৃষকের চাষের জমি, পুকুর, রাস্তাঘাট ভরে আছে প্লাস্টিক বর্জ্যে।

বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্রায় ৫ লাখ প্লাস্টিক বোতল বিক্রি হচ্ছে। বিবিসি নিউজ বলছে, বিশ্বজুড়ে এখন বছরে ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে গিয়ে পড়ে, ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে এর পরিমাণ হবে ১ লাখ ৩০ হাজার টন। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলমেন্ট অর্গানাইজেশন কর্তৃক বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নিয়ে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণ ও যুবকরাই প্লাস্টিক দূষণের জন্য বেশি দায়ী; যেসব খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিকের প্যাকেট রয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগের ভোক্তা ১৫ থেকে ৩৫ বছরের তরুণ ও যুবকরা।

করোনাকালে প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। যুগান্তরের এক প্রতিবেদন মতে, দেশে করোনার প্রথম মাসে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য; এর মধ্যে শুধু ঢাকায় এর পরিমাণ ৩ হাজার ৭৬ টন। মূলত সার্জিক্যাল মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজারের বোতল ও ত্রাণ বিতরণে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যাগ এ বর্জ্যরেই অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যবস্থার কি পরিবর্তন করা যায় না? প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারের উপায় বের করা কি অগ্রগতির এ যুগে খুবই কঠিন? মোটেই নয়, শুধু দরকার আমাদের সচেতনতা। গত এক দশকে আমরা যে পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহার করেছি, তা বিগত এক শতাব্দীতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের থেকেও বেশি।

মানুষের জীবনযাপনকে সহজ করার জন্য ১৮৫০ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার পার্কস প্রথম প্রাকৃতিক রাবার থেকে প্লাস্টিক তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে ১৮৬৯ সালে জন ওয়েসলে হায়াত কর্তৃক সেলুলয়ডের তৈরি সহজীকরণ পদ্ধতি এতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর ধারাবাহিকতায় চলতে থাকে প্লাস্টিক নিয়ে নতুন নতুন গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রম। এসব উদ্ভাবন মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করেছে, তবে একইসঙ্গে জীব-জগতের জন্য বহুবিধ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো প্লাস্টিক তৈরির শুরুর দিকে প্রযুক্তিবিদরা এর নেতিবাচক দিকের প্রতি নজরও দিতে পারেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এক গবেষণায় বলছে, দোকানে মুদিপণ্য বহনের জন্য যেসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়ের জন্য যেসব প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর ডায়াপার ও প্লাস্টিক বোতল টিকে থাকে ৪৫০ বছর পর্যন্ত। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশ-প্রতিবেশের যেমন সমস্যা তৈরি করছে, একইসঙ্গে ব্যক্তি, প্রাণীসহ সবকিছুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

মৎস্য ও ফসল উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ ব্যাহত হচ্ছে। নিরাপদ পানিপ্রাপ্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা তৈরি করছে, সর্বোপরি পৃথিবীর জলবায়ুকেই পরিবর্তন করে ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্য সৃষ্ট কারণগুলোই এখন মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। আর প্লাস্টিক বর্জ্য এর মাত্রাকে শুধু বাড়িয়েই চলেছে। পলিথিনের যুতসই বিকল্প যতদিন আবিষ্কৃত না হবে, ততদিন হয়তো আমাদের পলিথিন-প্লাস্টিক নির্ভরতায় থাকতে হবে। কিন্তু তাই বলে তো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। পলিথিন বর্জ্য যেন অন্তত ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ না হয়, সেজন্য সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে।

জীবন ধারণের যেসব ক্ষেত্রে প্লাস্টিকজাত পণ্যের বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ আছে, সেসব ক্ষেত্রে তা কাজে লাগাতে হবে। বাসাবাড়িতে কাচ-টিন-অ্যালুমিনিয়াম-স্টিলের বালতি, গামলা, জগ, কৌটা, শিশির ব্যবহার অনায়াসে চালু করা যায়। পিকনিক, সামাজিক অনুষ্ঠান বা বড় গ্যাদ্যারিংয়ে প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম থালা-বাসন, গ্লাসের ব্যবহার বন্ধ করা যায়। আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগে ওইসব অনুষ্ঠানে কিসের তৈরি ক্রোকারিজ, কাটলারিজ ব্যবহার করা হতো? আমরা কি এসব ভুলে গেছি? যেহেতু প্লাস্টিক-পলিথিন ব্যক্তি, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাই একটু সমস্যা হলেও তা মেনে নিয়েই এর ব্যবহার কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

পলিথিন-প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহারের পর বাসাবাড়ি, কর্মপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, রাস্তাঘাট, ডোবা-নালায় যত্রতত্র ফেলার কারণে পরিবেশ যেমন দূষিত ও বিষাক্ত হচ্ছে, একইসঙ্গে পয়ঃনিষ্কাশনেও জটিলতা ও জলবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। একই ডাস্টবিনে অন্যান্য বর্জ্যরে সঙ্গে পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জ্য না রাখাই ভালো। আর যদি একসঙ্গে রাখতেই হয়, তাহলে অন্তত তা বিনষ্টকরণের আগে অবশ্যই আলাদা করে নিতে হবে। প্রয়োজনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে পরিবেশবান্ধব করে ঢেলে সাজাতে হবে। প্লাস্টিক-পলিথিনের শেষ গন্তব্য যেন নদী-সাগর না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।

জাপানে শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজের ব্যবহার শেষে নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লাস্টিকসামগ্রী রিসাইকেল করে ব্যবহার করা হয়। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য প্রসেস করে রাস্তা, ঘরবাড়ি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো রাজ্যে প্লাস্টিক দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। অনেক দেশ প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি ও শক্তি উৎপাদনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। জৈব উপাদান ব্যবহার করে পচনশীল প্লাস্টিক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমাদেরও এ ধরনের উদ্যোগে শামিল হতে হবে। প্রয়োজনে অন্য দেশ, সংস্থার প্রযুক্তিগত সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে।

ব্যক্তি, পরিবারিক পর্যায়ে ব্যবহৃত প্লাস্টিকজাত পণ্যের বিকল্প সামগ্রীর মূল্য কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে মানুষ বিকল্প পণ্যগুলো ব্যবহারে আগ্রহী হবে। স্কুলের পাঠ্যসূচিতে প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে রচনা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করে এ বিষয়গুলো শিশুদের মন-মগজে গেঁথে দিতে হবে। এর ক্ষতিকর দিকগুলো ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে তুলে ধরতে হবে।

প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, রাষ্ট্র নানা কার্যক্রম গ্রহণ করছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে আমাদের সরকার ২০১০ সালে জুট প্যাকেজিং আইন পাস করেছে। ইতোমধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যরে ট্রান্স বাউন্ডারি মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণে একটি আইনি কাঠামো তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে ‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা, আইন মান্যতার তাগিদ সৃষ্টি না হলে রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কোনো কার্যক্রমই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। সরকারের এ শুভ উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী

snagari2012@gmail.com

প্লাস্টিক ব্যবহার কমাতে হবে

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম