|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চারপাশে তাকালে আপনি খাঁটি মুসলমান, খাঁটি ব্রাহ্মণ পাবেন। খাঁটি ক্যাথলিক, খাঁটি শূদ্র, খাঁটি ঘটি, খাঁটি বাঙ্গাল সবই পাবেন। তবে আহমদ শরীফের মতো খাঁটি অবিশ্বাসী পাবেন না।
কেউ কেউ এর সঙ্গে আরেকটু যোগ করে বলেন, খাঁটি বাঙালিও দুর্লভ এখন। হায় খোদা! পহেলা বৈশাখে এই যে হাজার কোটি টাকার পোশাকের বাজার, শত কোটি টাকার ফুলের বাজার, আরও শত কোটি টাকার ইলিশের বাজার; এই তাঁত বা খাদি বস্ত্র, ফুল ও ইলিশ ক্রেতারা কেউ তবে বাঙালি নন?
দুর্মুখরা বলেন, এরা কর্পোরেট বাণিজ্যতাড়িত কর্পোরেট বাঙালি। ষোলোআনা বাঙালিয়ানা দেখানোর নামে এদের আসল উদ্দেশ্য বেনিয়াগিরি। আমরা তা বলি না। বাঙালিত্ব নিয়ে আমরা মোটেই এত পিউরিটান নই।
যুগ-কাল এবং শতাব্দী পরিক্রমায় বাঙালির অভাব বদলেছে। সংস্কৃতিতে বদল আসবে না কেন? অভাবকে সম্ভ্রম দিয়ে মোকাবেলায় অক্ষম চর্যাপদের কবি একদা দুঃখ করে লিখেছিলেন- হাঁড়িতে ভাত নেই অথচ নিত্য নিত্য অতিথি।
এ এক বিব্রত দশা বটে। সে অভাব কি বদলায়নি? কয়েকশ’ বছর পর আরেক বাঙালি ঐতিহাসিক লিখেছেন- অতিথি খেলেই কেবল বাড়ির কর্তা খুশি নন। যে পর্যন্ত অতিথি খেয়ে হাসফাঁস না করছে, সে পর্যন্ত নিমন্ত্রণ কর্তা সন্তুষ্ট নন। অভাবী বাঙালির চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে ভারতচন্দ্র লিখেছেন- ‘অন্ন বিনে অন্নদার অস্থিচর্মসার’।
অস্থিচর্মসার সেই বাঙালির চেহারাও কি বদলায়নি? চেহারা বদলে বাঙালি হয়েছে ‘তৈল ঢালা স্নিগ্ধ তনু, নিদ্রা রসে ভরা’।
একসময় সেই তৈল ঢালা স্নিগ্ধ তনুর কদরও গেল বদলে। তৈল ঢালা স্নিগ্ধ তনুর বদলে ফিরে এলো জিরো ফিগার। অন্ন না পেয়ে অভাবের তাড়নায় অন্নদা অস্থিচর্মসার হয়েছিল। এখন স্বেচ্ছায় অস্থিচর্মসার হওয়ার দিন। ফ্রিজভর্তি খাবার-দাবার।
কিন্তু একে ছিঃ ছিক্কার করে শত হাত দূরে ঠেলে না রাখলে ফিগারের মান রাখা দায়। এখন এই জিরো ফিগার কিংবা ট্রাই শেইপ বাই শেইপ ধরে রাখতে মরিয়াদের যতই গুরু সদয় দত্তের পরামর্শ, ‘অনুকরণ খোলস ছেড়ে কায়মনে বাঙালি’ হওয়ার পরামর্শ দেয়া হোক, কেউ আর তৈল ঢালা স্নিগ্ধ তনুবিশিষ্ট নোয়া পাতিবুড়ির যুগে ফিরে গিয়ে খাঁটি বাঙালি হতে চাইবে না।
বাঙালিত্ব নিয়ে পিউরিটান হতে গেলে দেখা যাবে একজন খাঁটি বাঙালিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবর্তন এসেছে আড্ডায়। টেকচাঁদ ঠাকুর বাঙালির গুলির আড্ডার কথা লিখেছেন। গুলির আড্ডার আড্ডাবাজদের প্রধান আকর্ষণ ছিল আফিম।
আফিমের কারণে আড্ডাবাজরা মিলিত হতেন। এখনকার আড্ডার আফিম ফেসবুক। ফেসবুকই একমাত্র আফিম, যা লাখ লাখ আড্ডাবাজকে এক প্লাটফর্মে মেলাতে পারে।
সময়ান্তরে শুধু যে বাঙালির চেহারার বদল ঘটেছে তা নয়। স্বভাবও বদলে গেছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব/ ভদ্রমোড়া শান্ত বড় পোষমানা এই প্রাণ/ বোতাম আঁটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান/ দেখা হলেই মিষ্ট অতি/মুখের ভাবশিষ্ট অতি/ অলস দেহ ক্লিষ্ট গতি গৃহের পানে টান।’
অলস হিসেবে বাঙালির এই অপবাদ আর নেই। ‘অলস দেহ ক্লিষ্ট গতি গৃহের পানে টান’ এই মন্তব্য বাঙালির পরিবর্তে এখন মাল্টাবাসীর জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। গৃহের পানে টানও কমেছে। প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট ১২২টি দেশের মধ্যে জরিপ চালিয়েছে। তাতে সেরা অলস দেশ হিসেবে প্রথম স্থানে আছে দক্ষিণ আমেরিকার মাল্টা। পরিশ্রমী বাঙালি জাতিসংঘের শান্তি মিশনের শান্তিদূত হয়ে দেশে দেশে অশান্তির জট ছাড়িয়ে দিচ্ছে।
আইসল্যান্ড থেকে সোমালিয়া কোথায় নেই বাঙালি? বাঙালির বিদেশ যাওয়া এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। একসময় প্রবাস জীবনকে নির্বাসন এবং চরম শাস্তিতুল্য ভাবা হতো।
এখন হয়েছে উল্টোটা। এখন প্রবাসীকে রীতিমতো ঈর্ষার চোখে দেখা হয়। গৃহের টান ছাড়তে হলে ভাতের টানও ছাড়তে হয়। তা ছেড়েছে বাঙালি। ভেতো বাঙালির অপবাদ ঘুচেছে।
ভাতের চেয়ে ইতালিয়ান, মেক্সিকান, থাই ও টার্কিশ খাবারের দিকে ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছে। ঈশ্বরগুপ্ত লিখেছেন- ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সব। এখন ভাত-মাছ না খেলেও দিব্যি চলে যায় বাঙালির।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনে বাঙালির বেনিয়াপনা দৃষ্টিকটু- দুর্মুখদের এই মন্তব্য যদি সত্যিও হয়. তাতেই বা সমস্যা কোথায়? বাঙালি যে ব্যবসা করতে পারে না, এ নিয়ে তো তাকে কম অপবাদ সহ্য করতে হয়নি।
‘বাঙালিদিগের বাণিজ্যে প্রবৃত্তি নাই, সংগ্রামে গতি নাই, আয়াসকর কার্যে মতি নাই, ভোজ্য ও শয়ন অতি কোমল, সুতরাং বিলাসেই গাঢ়তর অনুরাগ জন্মিয়াছে।’ কবিগুরু দেখুন, আপনার বাঙালি ব্যবসা করতে শিখেছে।
শুধু শিখেইনি তাতে এমন পারঙ্গমতা অর্জন করেছে যে পহেলা বৈশাখ নিয়েও সে বাণিজ্য করতে ছাড়ে না। মুগ্ধ জননী বাঙালিকে ব্যবসা শিখিয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষ করে ছেড়েছে। বাঙালি বদলে যেতে ভালোবাসে।
১৯৫০-এর দশকে যে নজরুল বাঙালির কাছে ছিলেন কাফের, ষাটের দশকে সেই নজরুলই হয়ে উঠলেন অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। বাঙালি একটু দ্রুতই বদলে যেতে ভালোবাসে? বলা মুশকিল।
পোশাকে বাঙালির পরিবর্তন খুবই উল্লেখযোগ্য। রাজকুমার চন্দ্র আক্কেলগুড়ুম গ্রন্থে লিখেছেন- ‘দশ হাত কাপড়ে স্ত্রীলোক লেঙটো।’ প্রাত্যহিক পোশাকের তালিকায় দশ হাত কাপড় প্রায় পরিত্যাজ্য।
তবে তখনও যেমন ধারণা ছিল দশ হাত কাপড়ে স্ত্রীলোক লেঙটো, এখনও তেমন মেয়েরা যাই পড়ুক না কেন, অনেকের কাছে তা ‘লেঙটো’ বলেই মনে হয়। পোশাকে পরিবর্তন এসেছে বটে, তবে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসেনি।
আরেকটি স্বভাবেও বাঙালি অনমনীয় রয়ে গেছে। সেটা তোষামোদি ও চাটুকারিতা। স্বয়ং বিবেকানন্দ লিখেছেন- বাঙালি বলবানের পদলেহন আর দুর্বলের যমস্বরূপ। তোষামোদি, চাটুকারিতা ও লেজুরবৃত্তির এই স্বভাব বাঙালির মজ্জায় ঢুকল কীভাবে?
বাঙালি দীর্ঘকাল বিদেশি শাসনের অধিকারে ছিল। সেন, তুর্কি, মোগল, পাঠান, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ ও পাকিস্তানি শাসকদের মোসাহেবি-চাটুকারিতা করে করে বাঙালির মজ্জায় এসব ঢুকে গেছে হয়তো।
শুধু যে কেন্দ্রেই এই লেজুড়বৃত্তির প্রবণতা ছিল তা নয়, কেন্দ্র থেকে পরিধি ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল লেজুড়বৃত্তি। জমিদার, জোতদার, তালুকদার, নায়েব, এমনকি লাঠিয়ালদেরও তোয়াজ করে চলতে হয়েছে তৃণমূল গ্রামীণ মানুষের।
বাঙালি নিজেকে বাঘের সঙ্গে তুলনা করে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলে। কিন্তু নিজেকে ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারলে দেখত তার মধ্যে আছে কিছুটা শৃগালের চালাকি, কিছুটা বিড়ালের তোষামোদি আর কিছুটা হনুমানের লম্ফঝম্ফ।
‘দাস্যসুখে হাস্যমুখ, বিনীত জোড়-কর, প্রভুর পদে সোহাগ মদে দোদুল কলেবর। পাদুকা তলে পড়িয়া লুটি, ঘৃণায় মাখা অন্নখুঁটি, ব্যগ্র হয়ে ভরিয়া মুঠি যেতেছে ফিরে ঘর।’ এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে? ভাবুন একবার।
জয়া ফারহানা : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
