চিরকুটের বোবা অক্ষরগুলোর মর্ম বুঝতে হবে
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের শরীরে বাসা বেঁধেছিল প্রাণঘাতী ক্যানসার। তাই বলে জীবন তো থেমে থাকে না। যতদিন বেঁচে থাকা ততদিন লড়াই। সেটি যতটা না বেঁচে থাকার লড়াই, তার থেকে বেশি অনিশ্চিত মৃত্যুকে জয় করার লড়াই। মানুষের মৃত্যু যত কাছাকাছি আসে, সৃষ্টি তত মানুষের চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে ইতিহাসের খাতায় নাম লেখাতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার কলকাতার হাওড়া স্টেশনে বসে অপেক্ষা করছেন ট্রেনের। চেন্নাই যাবেন ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে। মাথাটা গিজ গিজ করে উঠল। নতুন কোনো সৃষ্টির ধারণা মাথা থেকে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় যেন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। প্রতিদিনের মতো পকেটের মধ্যে কলমটা থাকলেও একটুকরো কাগজ পাচ্ছেন না, যেখানে নতুন চিন্তাধারাগুলো লিপিবদ্ধ করতে পারেন। টেনে নিলেন সিগারেটের প্যাকেট। তার পেছনেই লিখলেন কফি হাউজের গানের শেষ লাইনগুলো-‘সেই সাতজন নেই এক টেবিলটা তবু আছে... কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে, কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়, কতজন এলো গেল, কতজনই আসবে, কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়।’
নতুন সৃষ্টির জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বড় বড় ইট-পাথরের দালানকোঠা লাগে না। আধুনিক স্থাপত্যকলার ছোঁয়ায় ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে নান্দনিকতার প্রয়োজন হয় না। দামি দামি প্রযুক্তির উপাদান আর আসবাবপত্রের কারুকাজখচিত দৃষ্টিনন্দন চাকচিক্যের দরকার হয় না। সৃষ্টি এমন এক শক্তি, যার জন্ম যে কোনো পরিবেশেই হতে পারে। সৃষ্টির কোনো স্বর্গ-নরক নেই। একটি খালি সিগারেটের প্যাকেট মূল্যহীন কাগজের চেয়েও মূল্যহীন। অথচ ছেঁড়া সে কাগজটা মানুষের চিন্তা দ্বারা পুষ্ট হয়ে মহামূল্যবান হয়ে ওঠে। আসলে আমরা যেটি মূল্যবান ভাবি, সেটি হয়তো মূল্যহীন আর যেটিকে মূল্যহীন ভাবি, সেটি হয়তো মূল্যবান। যেমন অনেক মানুষের কাছে সিগারেটের কাগজের থেকে এর ভেতরে থাকা সিগারেটগুলো মূল্যবান। কিন্তু নিখাদ সত্য হলো, একটা সিগারেট নিঃশেষ হওয়ার পাশাপাশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। যেটি মানুষের জীবনে মৃত্যু ডেকে আনে, সেটি কখনো মূল্যবান হয় না। তবে সিগারেটের কাগজটিকে যদি চিরকুট হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তবে তা মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে। মানুষের ভেতরও অদৃশ্য চিরকুট থাকে। মহাদেব সাহার অস্তমিত কালের গৌরব কাব্যগ্রন্থের চিরকুট কবিতাটি কেমন করে যেন মনস্তত্ত্বের ভেতরের দর্শনকে আঘাত করে জানিয়ে গেল-‘হঠাৎ সেদিন হাতে পেয়ে চিরকুট, নিমিষে সময় হয়ে গেল যেন লুট; পার হয়ে বহু বছরের ব্যবধান, কানে ভেসে এলো হারানো দিনের গান।... এই বয়সেও একখানি চিরকুট, তোলে শিহরণ, কম্পিত করপুট।’
এমন একটি চিরকুট মানুষ তার নিজের অজান্তে সারা জীবন খুঁজে বেড়ায়; যেটি মানুষের রক্তের ভেতরে মিছিল করে মানুষকে তার ফেলে আসা জীবনের গভীরে নিভৃতে বসে থাকা শেকড়ের কাছে নিয়ে যায়। মানুষ যে একদিন মানুষ ছিল, তা মানুষকে চেনানোর চেষ্টা করে। সেই চিরকুটটি কাচের আয়না হয়ে মানুষকে ক্রমাগত বর্তমান থেকে পেছনে, আরও পেছনে নিয়ে যায়। সেটি জাদুর আয়নার মতো হয়। সেই আয়নাটি যতই মানুষকে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে থাকে, মানুষ ততই সেই আয়নার ভেতরে দানব থেকে ক্রমাগত রূপান্তরিত হওয়া একজন মানবকে আবিষ্কার করে। কী অদ্ভুত সে অভিজ্ঞতা! সেটি বুকে কম্পন তোলে। মনে শিহরণ জাগায়। একদিন যে মানুষটি মানব ছিল, সে যে ক্রমাগত দানব হয়ে উঠেছে; তা সে বুঝতেও পারেনি। অথচ চিরকুটটি সে আয়নায় যদি মানুষকে দেখাতে পারত, সে কোনো একটা সময়ের জন্য মানুষ ছিল না; বরং সব সময় সে মানুষ ছিল। আগেও মানুষ ছিল, এখনো মানুষ আছে, ভবিষ্যতেও মানুষ থাকবে! তবে মানুষের সত্তার ভেতরে বোবার মতো অনাদরে পড়ে থাকা চিরকুটটি মহামূল্যবান হয়ে উঠত।
চিরকুটটির দুঃখ হয়তো এখানেই। তবে চিরকুটের দুঃখ শুধু এখানেই না, অন্যখানেও থাকে। নিকোলা টেসলা। ভুল সময়ে জন্মানো এক কিংবদন্তি। তবে ভুল সময়টি এখনো বিদ্যমান। যেখানে নিভৃতে পড়ে থাকা সাদাসিধে গুণী মানুষকে মূল্য না দিয়ে আমরা ভুঁইফোঁড় গোছের ভুল মানুষকে মূল্যায়ন করে চলেছি। বর্তমানে ভুল সময়ে জন্মানো মানুষকে পৃথিবী হয়তো আরও অনেক বছর পর চিনবে, ততদিনে মানুষটির দেহ হয়তো মাটিতে মিশে যাবে। তারপরও ইতিবাচক মন বলছে, মানুষটি তখন আবার নতুন করে বেঁচে উঠবে মানুষকে ইতিহাসের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে। সেদিন রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতো ভুল সময়ে জন্মানো মানুষটি অভিমান করে যেন বলে উঠবে-‘আমি সেই অবহেলা, আমি সেই নতমুখ, নীরবে ফিরে যাওয়া অভিমানভেজা চোখ, আমাকে গ্রহণ কর। উৎসব থেকে ফিরে যাওয়া আমি সেই প্রত্যাখ্যান, আমি সেই অনিচ্ছা নির্বাসন বুকে নেওয়া ঘোলাটে চাঁদ। আমাকে আর কি বেদনা দেখাবে?’
সে যাই হোক। ১৮৮৬ সালের ১০ জুলাইয়ের এক গভীর রাতে টেসলার জন্ম। আকাশে লাখো তারার আলো ঝলমল রাত সেটি ছিল না। ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাতে উথালপাথাল ছিল সে রাত। প্রকৃতির রুদ্ররূপ যেন নেমে এসেছিল পৃথিবীতে। প্রকৃতির এই রুদ্ররূপ দেখে ধাত্রী বলেছিল-‘এই শিশু হবে অন্ধকারের সন্তান।’ কিন্তু সদ্যোজাত টেসলারের মায়াবি মুখটির দিকে তাকিয়ে তার জন্মদাত্রী মা বলেছিল-‘না, এ হবে আলোর সন্তান।’ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বড় হতে থাকেন তিনি। অনেক বড় বড় আবিষ্কার করেন তিনি; যেমন-এসি কারেন্ট, রঞ্জনরশ্মি, টেসলা কয়েল, টেলিফোর্স, ভায়োলেট রশ্মি, রিমোট কন্ট্রোল, ইলেকট্রিক মোটর, টেসলা টারবাইন, ওয়্যারলেস বা তারবিহীন প্রযুক্তি, ওয়ার্ল্ড ওয়্যারলেস সিস্টেম। এ আবিষ্কারগুলো করেই তিনি থেমে থাকেননি; রাডার তৈরির থিওরি দেন তিনি। হাড্রোইলেকট্রিসিটির প্রথম ধারণা দেন তিনি। ক্রয়োজেনিক ইঞ্জিনিয়ারিং উদ্ভাবনের অর্ধশতক আগেই তিনি এটি নিয়ে কাজ করেন। ট্রানজিস্টার বানানোর উপকরণগুলোর পেটেন্ট ছিল টেসলারের। এটি ছাড়া আজকের কম্পিউটারের জন্মই হতো না। রেজোনেন্ট ফ্রিকোয়েন্সি আবিষ্কার করেন টেসলা। তিনি ভূ-কম্পনযন্ত্র উদ্ভাবন করেন। নিয়ন লাইট, বল লাইটিং, কৃত্রিম বজ্রপাতসহ অনেক বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলো করে গেছেন তিনি। তার আবিষ্কৃত নতুন ধারণাগুলো ইনভেস্টরদের আকৃষ্ট করতে পারেনি সে সময়। বিজ্ঞানী এডিসনও তার বিরোধিতায় শামিল হয়েছিলেন। এডিসন টেসলারের এসি কারেন্টের নাম দিয়েছিলেন ডেথ কারেন্ট। জনসমক্ষে এ এসি কারেন্ট দিয়ে তিনি বিড়াল ও কুকুরকে মেরে মানুষকে বুঝাতে চেয়েছিলেন-টেসলা যা আবিষ্কার করেছে, তা অন্ধকার পৃথিবীর মানুষের আবিষ্কার। এটি কি ঈর্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যে টিকে থাকার লড়াই; নাকি অন্যকিছু, তা খুঁজবেন ইতিহাসবিদরা। অথচ আজকের দিনে পৃথিবীকে যেসব প্রযুক্তি ঘিরে রেখেছে, তা তিনি সে সময় আবিষ্কার করলেও তখনকার কপালপোড়া মানুষ তাকে মূল্যায়ন করতে পারেনি। কারণ মানুষ তো এমনই হয়। কঠিন সত্য-মিথ্যার আস্তরণ দিয়ে চাপা দিতে দিতে অনেকটা নিচে ফেলে দেয়। কিন্তু সত্যের শক্তি যে অনেক, তা সময়ের অপেক্ষা করে। পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়। মানুষকে সময়ের পরীক্ষায় টেনে এনে একটু একটু করে শেখাতে শেখাতে একদিন চরম বাস্তবতার বোঝা মানুষের মাথায় তুলে দিয়ে চিৎকার করে বলে-‘এবার তোমার চোখ খোল, মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোল, যা সত্য তা স্বীকার কর।’
টেসলা অনাদরে মরেছেন-অতি দরিদ্র ও ঋণগ্রস্ত অবস্থায়। দুধ আর বিস্কুট খেয়েই শেষ দিনগুলো পার করেছেন একটি হোটেলে। বিয়েটা করেননি এই ভেবে যে, সংসার করতে গেলে যদি তা কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পাদপ্রদীপের নিচে পড়ে থাকা মানুষটি আমাদের ত্যাগী হতে শিখিয়েছেন। মানুষ হতে শিখিয়েছেন। সব মৌলিক ধারণা, সমসাময়িক সময়ে মূল্যহীন-তাও হয়তো আমাদের শিখিয়েছেন। একবার আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল-‘পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোক হিসাবে আপনার অনুভূতি কেমন?’ তিনি এর উত্তর দিয়েছিলেন এভাবে-‘আমার জানা নেই। আপনি নিকোলা টেসলাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।’ খুব রহস্যময় উত্তর। যে যেভাবে পারে এ উত্তরটিকে সে সেভাবে দেখতে পারে। মার্ক টোয়েনের বই পড়তে পড়তে একসময় মার্ক টোয়েনকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছেন। চিরকুট হয়তো এখানেই বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের মেলবন্ধনের সমীকরণটা মিলিয়েছে তার মতো করে। মার্ক টোয়েনের আসল নাম স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লেমেন্স হলেও তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন সব সময়। ছদ্মনামের সুবিধা হলো কেউ আপনাকে চিনবে না; অথচ আপনি আপনার কর্ম ও অবদান দ্বারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দেবেন। টেসলা সে সময় সেটি পারেননি, মার্ক টোয়েন নামের অচেনা একটি মানুষ সেটি পেরেছেন। কারণ, মানুষ চেনাদের মূল্যায়ন করে না, অচেনাদের মূল্যায়ন করে। যেমন-‘চেনা চেনা মনে হয় তবু অচেনা’ এই গভীর তত্ত্বটি চিরকুটে লেখা থাকে তার মতো করে। এভাবেই চিরকুটটি মানুষের ভেতরের মনটাকে আঘাত করে আসল মানুষটিকে বের করে আনুক। চিরকুটের না বলতে পারার দুঃখটা মানুষ বুঝুক তার জীবনবোধ দিয়ে।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
asadzmn2014@yahoo.com
