Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

একটি সময়োপযোগী নির্দেশনা

Icon

আবদুল লতিফ মণ্ডল

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একটি সময়োপযোগী নির্দেশনা

দেশের সব জলাভূমির (wetland) সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক জলাভূমি মন্ত্রণালয় গঠন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কৃষিজমি, নিুভূমি, জলাভূমি ও মেঘনা নদী অংশের জমি ভরাটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা রিটের ওপর বেঞ্চটির পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।

রায়ে বলা হয়, যেহেতু বাংলাদেশ ‘রামশার কনভেনশন’ বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করেছে, সেহেতু ওই অঙ্গীকার ও চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দ্রুত নীতিমালা গ্রহণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আইনগত দায়িত্ব-কর্তব্য। রায়ে দেশের সব জলাভূমিকে রাষ্ট্রের সম্পত্তি (পাবলিক ট্রাস্ট প্রপার্টি) ঘোষণা করা হয়েছে।

রামশার কনভেনশন-১৯৭১ অনুযায়ী জলাভূমির সংজ্ঞা হচ্ছে- ‘প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট, স্থায়ী অথবা অস্থায়ী, স্থির অথবা প্রবহমান পানিরাশি বিশিষ্ট স্বাদু, লবণাক্ত অথবা মিশ্র পানি বিশিষ্ট জলা, ডোবা, পিটভূমি অথবা পানিসমৃদ্ধ এলাকা এবং সেই সঙ্গে এমন গভীরতা বিশিষ্ট সামুদ্রিক এলাকা, যা নিু জোয়ারের সময় ৬ মিটারের বেশি গভীরতা অতিক্রম করে না।’ বাংলাদেশে জলাভূমির আওতায় মোট এলাকা ৭০ থেকে ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার, যা দেশের মোট ভূ-ভাগের প্রায় অর্ধেক।

উচ্চ আদালত জলাভূমির সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য জলাভূমি মন্ত্রণালয় গঠন করতে বলেছেন। এখন দেখা যাক জলাভূমির সুরক্ষা ও উন্নয়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রতিবেশগত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে জলাভূমিগুলো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। দেশের জলাভূমিগুলো একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল, অন্যদিকে তেমনি এগুলো মানববসতি, জীববৈচিত্র্য, মাছ উৎপাদন, কৃষি বহুমুখীকরণ, নৌ চলাচল ও যোগাযোগ এবং প্রতিবেশ-পর্যটন ইত্যাদির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং ন্যাচার কনজারভেশন মুভমেন্ট পরিচালিত এক যৌথ গবেষণা মোতাবেক প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি সপুষ্পক উদ্ভিদ এবং ১৫০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী দেশের জলাভূমিগুলোতে পাওয়া যায়। ৪০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী এবং প্রায় ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ তাদের জীবনকালের পুরো অংশ বা আংশিক সময়কালের জন্য জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল থাকে।

স্বাদু পানির মৎস্য আহরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা। প্রাণীজ আমিষের অন্যতম জোগানদাতা হচ্ছে এ স্বাদু পানির মাছ। স্বাদু পানিতে মাছ ধরে লাখ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার মানুষ সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাছাড়া বদ্ধপানিতে মাছ চাষ একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এতে একদিকে যেমন বিনিয়োগকারীরা লাভবান হচ্ছেন, তেমনি অন্যদিকে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হছে। তাছাড়া বদ্ধপানিতে মাছ চাষ আমাদের আমিষের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বড় জলাশয় যেমন- নদী, হ্রদ ও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় মানববসতি গড়ে উঠেছে। দেশে নদীর তীরে গড়ে ওঠা শহর, নগর ও বন্দরগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর। আদিকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি। সেখানেও মূল ভূমিকা নদীর। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি যোগ হয়েছে। ব্যবস্থা হয়েছে আধুনিক সেচের।

এজন্য বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর সবই নদীকে কেন্দ্র করে। ধান চাষে জলাভূমিগুলোর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। উদাহরণস্বরূপ বৃহত্তর সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার হাওড়াঞ্চলে বোরো চাষ হয়। আগাম বন্যায় এসব এলাকার বোরো ফসল তলিয়ে না গেলে তা দেশে চাল উৎপাদনে বিরাট ভূমিকা রাখে।

যোগাযোগ ব্যবস্থায়, বিশেষ করে দেশের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় জলাভূমিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও- অর্থাৎ বর্ষাকালে নাও আর শুকনো মৌসুমে হাঁটা ছাড়া বিকল্প ছিল না দেশের মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের হাওড়বাসীর। এখন কোনো কোনো হাওড় এলাকায় রাস্তা নির্মিত হলেও এখনো বর্ষাকালে অনেক হাওড় এলাকায় নৌকা যাতায়াতের অন্যতম অবলম্বন। নদীতে চলাচলকারী স্টিমার, লঞ্চ ইত্যাদি এখনো দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে যখন পানির চাহিদা বাড়ছে এবং বন্যা ও খরার ঝুঁকি বাড়ছে, তখন টেকসই উন্নয়নে জলভূমির ভূমিকা আগের তুলনায় অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ যে কার্বন নিঃসরণ, তা কমানোরও এক প্রাকৃতিক পদ্ধতি জলাভূমিগুলো। সোজা কথায়, জলাভূমিগুলো জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলায় একইসঙ্গে অ্যাডাপটেশন ও মিটিগেশন ব্যবস্থা।

অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প (রাস্তা, বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি) গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জলাভূমিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানববসতি স্থাপনে জমির চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য মেট্রোপলিটন নগরীতে এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এতে এসব নগরীর আশপাশের জলাভূমি মানববসতি স্থাপনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, যার ফলে অনেক জলাভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তপ্রায়। এটি পরিবেশের সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

মহানগরী, বিভাগীয় ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণের জন্য সরকার ২০০০ সালে একটি আইন প্রণয়ন করে। এখানে প্রাকৃতিক জলাধার বলতে নদী, খান, বিল, দিঘি, ঝরনা বা জলাশয় হিসাবে মাস্টারপ্ল্যান চিহ্নিত বা সরকার বা কোনো সংস্থা কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা বন্যা প্রবাহ এলাকা হিসাবে ঘোষিত কোনো জায়গা এবং সলল পানি ও বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোনো ভূমিকে বোঝানো হয়েছে। তবে এগুলো রক্ষার্থে আইনটির তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত, গ্রামাঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো এ আইনের আওতাভুক্ত নয়। এ আইনটি ছাড়া কয়েকটি সেক্টরাল আইন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক্যানাল আইন ১৮৬৪, মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০, ইরিগেশন আইন ১৮৭৬, পরিবেশ আইন ১৯৯৫। তবে এসব আইনে জলাভূমি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান নেই।

এসব বিবেচনায় নিয়ে ২০০৫ সালে তৎকালীন সরকার সারা দেশে জলাশয় ও জলাভূমি সংরক্ষণে একটি কমপ্রিহেন্সিভ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। এটির একটি খসড়াও প্রণয়ন করা হয়। এ খসড়ায় যা অন্তর্ভুক্ত হয় সেগুলোর মধ্যে ছিল- ক. নদী-বন্দর এলাকায় নদীর ৫০ মিটারের মধ্যে এবং বন্দর এলাকার বাইরে নদীর ১০ মিটারের মধ্যে কোনো প্রকার অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না।

খ. জলাভূমিতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি হয় এমন কোনো স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করা যাবে না। গ. নিুভূমি, বন্যায় তলিয়ে যাওয়া সমতল ভূমি এবং রিজার্ভারগুলো সংরক্ষিত থাকবে এবং এগুলো মাটি দ্বারা ভরাট করা যাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খসড়াটি আইনে পরিণত হয়নি। জানা যায়, কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির চাপে আইনটির প্রণয়ন সম্ভব হয়নি। আলোচ্য রায়ে উচ্চ আদালত জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় পৃথক আইন করতে বলেছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী নির্দেশনা।

সবশেষে বলতে চাই-প্রতিবেশগত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করে এগুলোর সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে আর দেরি নয়। তাই এগুলোর সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় পৃথক আইন করার জন্য উচ্চ আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তার বাস্তবায়ন দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।

আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

জলাভূমি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম