রাজনীতির অঙ্গনে সুবাতাস বয়ে যাক
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দিনে দিনে রাজনৈতিক অঙ্গন সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, হচ্ছে; সাধারণ মানুষের মধ্যে। শুধু আমাদের দেশে নয়, উপমহাদেশজুড়েই একই মনোভাব। ভারতীয় চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক নেতারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেগেটিভ চরিত্র হিসাবে উপস্থাপিত হন। ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে সবাইকে দমিয়ে রাখতেন চান। অন্যায়-দুর্নীতির গডফাদার হিসাবেই তাদের পরিচিত করানো হয়। কেন এভাবে চিত্রিত হয়?
চলচ্চিত্র নাটকের কাহিনি যদি সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হয়, তাহলে বলতে হবে এসব কাহিনি-চরিত্র সবই জীবন থেকে নেওয়া। কিন্তু সবটুকুই কি চলমান সমাজ ও জীবনের বাস্তবতা? রাজনীতিকদের অনেকেই যে দেশপ্রেম বুকে নিয়ে রাজনীতি করেন, দেশকল্যাণে ভূমিকা রাখেন বা রাখতে চান, তা প্রায় সময়েই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তবে এর পেছনে রাজনীতির ভুল দর্শন ও নীতিনির্ধারণকেই দায়ী করা যায়।
মানতে হবে, এককালের ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর অংশ আমাদের বাংলার রাজনীতি অতীতে এমন ছিল না। রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন নমস্য এবং রাজনৈতিক দলসংশ্লিষ্টদের লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ। মহাত্মা গান্ধী থেকে নেহেরু পর্যন্ত ভারতীয় নেতা-নেত্রীরা পরাধীন ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ফলে দলীয় রক্ষণশীলতায় আটকে না থেকে সর্বভারতীয় দৃষ্টিতে তারা রাজনীতি করেছেন। বাংলায় সুভাষ বোসদের রাজনীতিও ছিল ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
রাজনীতি কিছুটা জটিল হয়েছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ইস্যুতে। হিন্দু-মুসলমানদের রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটল ধরে এ পর্বে। রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার কালো ছায়া আছড়ে পড়ে। পূর্বের উদার অবস্থা থেকে তখন অনেকটা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে রাজনীতি। এরপরও পাকিস্তান পর্বে আমাদের অঞ্চলের রাজনীতি ততটা গোষ্ঠীতন্ত্রে সংকীর্ণ হয়ে যায়নি। এর পেছনেও হয়তো আরেক ধরনের ঔপনিবেশিকতা ভূমিকা রেখেছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ নীতির বিরুদ্ধে দলমতনির্বিশেষে আন্দোলনে একটি ঐক্যবদ্ধ রূপই ছিল। পাকিস্তানের সমর্থক মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীকে আলাদা করে রেখে পূর্ব পাকিস্তানের সব দলেরই ছিল অধিকার আদায়ের লড়াই। তাই রাজনীতির নামাবরণে দলীয় দুর্নীতি ও ব্যক্তিগত দুর্নীতির ধারণা এ পর্বে প্রবল ছিল না। ধীরে ধীরে আন্দোলন স্বায়ত্তশাসনের লড়াই থেকে মুক্তির আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। রাজনৈতিক দর্শন ও নেতৃত্বের গুণে বঙ্গবন্ধু হয়ে পড়েন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। এ পর্বেও এ দেশের রাজনীতি কূপমণ্ডূকতায় সংকীর্ণ হয়ে পড়েনি। দুর্নীতির ধারণা সামনে আসেনি। সে সুযোগও তেমন ছিল না। রাষ্ট্রক্ষমতা তো আর বাঙালির হাতে ছিল না তখন!
অবস্থা পালটে যেতে থাকে স্বাধীনতার পরে। বাঙালির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে আসার পর আলোর পথ ছেড়ে অন্ধকার পথেই যেন অনেকে চলতে পছন্দ করল। বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বিশাল মানুষকেও আক্ষেপ করতে হলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে তিনি যখন প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে ও প্রজ্ঞা দিয়ে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছিলেন, তখনই ‘চোরের দল’ আর ‘চাটার দল’ বলে আক্ষেপ করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অন্ধকার আরও জেঁকে বসতে থাকে।
পরাজিত পাকিস্তানি আর মার্কিন নেতৃত্ব প্রতিশোধ স্পৃহায় ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এর প্রথম বহিঃপ্রকাশ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী হিসাবে জিয়াউর রহমান সেনানিবাসের ভেতর থেকে জন্ম দেন বিএনপি নামের দলটিকে। সেই সঙ্গে জুটিয়ে নেন স্বাধীনতাবিরোধী সামরিক, বেসামরিক ব্যক্তিদের।
যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীকে দোসর বানান। এ সময় থেকে আরও জটিলভাবে রাজনীতি কলুষিত হতে থাকে। এ দেশের নানা ঘরানার রাজনীতি কঠিন দলতন্ত্রে বন্দি হয়ে পড়ে। দেশপ্রেমের বদলে সুবিধাবাদিতা জায়গা করে নেয়। বড় দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের গায়ে সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজির টিকিট সেঁটে যেতে থাকে। মননশীল মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়।
এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দলীয় ছাত্রদের চরিত্র পালটে যেতে থাকে। ষাটের দশকের দেশপ্রেমে মণ্ডিত আলোকিত ছাত্ররাজনীতির ছিটেফোঁটাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের পেশিশক্তি সবল রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলোকে কার্যত বিলুপ্ত করে দেয়। তাই রাজনৈতিক দলের সহযোগী দাপুটে ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থী আর শিক্ষাবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণের বদলে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডেই নিজেদের যুক্ত রাখে বেশি। এসব কারণে মেধাবী ছাত্ররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে রাজনীতির ব্যাপারে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও কি নিষ্কলুষ থেকেছেন? এভাবেই রাজনৈতিক নেতারা গণবিচ্ছিন্ন হতে থাকেন। এসব কারণে সম্ভবত জনজীবনে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে এতটা নেতিবাচক হিসাবে রাজনৈতিক চরিত্রগুলো উপস্থাপিত হয়।
কিন্তু আমি মনে করি, বর্তমান ধারার রাজনীতির এসব খণ্ডিত রূপ। এখনো রাজনীতি অঙ্গনের অনেক নেতা-নেত্রী, কর্মী-সমর্থক আছেন, যারা দলকে যেমন ভালোবাসেন; তেমনই দেশকেও ভালোবাসেন। দেশের নানা সংকটে তারা ভূমিকা রাখেন। কিন্তু বিভিন্ন নেতিবাচক ধারণার ডামাডোলে এসব সুকীর্তি প্রায়ই সামনে আসে না বা দলও তেমনভাবে প্রচার করে না। অনেক সংবাদমাধ্যম নেতিবাচক রিপোর্ট সংগ্রহ ও প্রচারে ব্যস্ত থাকে বলে এ দেশের সাধারণ মানুষ অনেক কিছু জানতে পারে না।
আমার এ বিশ্বাসটি আরও স্থির হলো ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ৩২, ধানমন্ডির বাড়ির সামনে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুবাদে। আমি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষ নই। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ধারার শিক্ষক রাজনীতির বিরোধীও বলা চলে আমাকে। শিক্ষা-গবেষণার বাইরে অন্য কোনো ‘উচ্চাভিলাষ’ও নেই। তবুও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিচ্ছিন্ন নয়, এমন কোনো রাজনৈতিক দল যদি একাডেমিক সংশ্লিষ্ট কথা বলতে আমন্ত্রণ জানায়; সুযোগ থাকলে সেখানে আমি যাই।
প্রতিবছর স্বেচ্ছাসেবক লীগ ১৫ আগস্ট সামনে রেখে এখানে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এবার বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে আলোকচিত্রে। শাহাবুদ্দিন মজুমদার নামে একজন প্রবীণ গবেষক এ সংক্রান্ত একটি আলোকচিত্রসংবলিত বই রচনা করেছেন। তার অনুরোধে পাণ্ডুলিপিটির ইতিহাসের ধারাবাহিকতা দেখে দিয়েছিলাম আমি। এ পাণ্ডুলিপির আলোকেই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন। এ কারণেই সম্ভবত আমি আমন্ত্রিত হয়েছি।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের অনুষ্ঠানে আসা আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই আয়োজকদের আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। কারণ, এখানে না এলে জানতে পারতাম না ক্ষমতাসীন দলের একটি সহযোগী সংগঠন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কত ইতিবাচক কাজ করে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী, বাহাউদ্দিন নাছিম, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। আমি উপভোগ করছিলাম। নানা দিক থেকে কর্মী-সমর্থকরা স্লোগান দিয়ে প্রবেশ করছে; কিন্তু ভেতরটা ভীষণ সুশৃঙ্খল।
নেতাদের বক্তৃতায় এ সংগঠনের কর্মভূমিকার কথা জানছিলাম। তারা আমাকে উপহার দিলেন তাদের একটি সুদৃশ্য প্রকাশনা। আমি আলোকিত হলাম। বিশেষ করে কোভিডকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশ পালন করে সংগঠনের নেতাকর্মীদের জনকল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়ার নানা কর্মপ্রয়াসের কথা জেনে। জানলাম, এ সংগঠন হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক বিতরণ, খাদ্য সহায়তা, টেলি হেলথ সার্ভিস, কল সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে অসুস্থ মানুষদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের বিনামূল্যে পরামর্শ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে।
এছাড়া তারা বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দিচ্ছে। শুধু ঢাকা নয়-চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও সিলেট বিভাগেও সংগঠনের পক্ষ থেকে একই সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ টিম গঠন করে করোনা রোগীর লাশ গোসল, জানাজা, দাফন ও সৎকারের কাজ করে যাচ্ছে। জানতে পারলাম, রমজান ও ঈদ উপলক্ষ্যে এ সংগঠন দুস্থদের মাঝে খাদ্যসামগ্রী ও ঈদ উপহার বিতরণ করেছে।
কৃষি শ্রমিক সংকটের সময় সংগঠনের কর্মীরা ধান কেটে মাড়াই করে কৃষকের ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের উদ্যোগে করোনাকালে দুস্থের কল্যাণে একাধিক ফ্রি সবজি বাজার স্থাপন করা হয়েছে। আমি জেনে আনন্দ পেলাম যে, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
এসব তথ্য আমাকে ভীষণ স্বস্তি দিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের বিশাল কর্মী বাহিনীকে যদি জনকল্যাণ ও দেশ কল্যাণে নিয়োজিত রাখতে পারে, তাহলে রাজনীতি নিয়ে মানুষের হতাশা আস্তে আস্তে কেটে যাবে। এভাবে গঠনমূলক কর্মযজ্ঞে যুক্ত করতে পারলে অন্ধকারে পথ হাঁটার সুযোগও কমে যাবে। আমি ভাবছিলাম-রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক ছিদ্রান্বেষণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে যদি গঠনমূলক সমালোচনার মেধাবী আচরণ দেখাতে পারে, তবে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিই পালটে যাবে।
আরেকটু সাহসী হয়ে যদি কঠিন দলতন্ত্রের মানসিকতা থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসা যায়, তবে তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশকারী’রা নন; রাজনৈতিক দলের আদর্শকে যারা ভালোবাসেন, এমন অনেক মেধাবী ভালো মানুষ ‘অনু’ নয়, আনন্দের সঙ্গে পছন্দের দলে ‘প্রবেশ’ করবেন। এতে দলের শ্রীবৃদ্ধি যেমন ঘটবে, দলীয় কাঠামোও তেমনই দৃঢ় হবে। তবে আমাদের দেশের রাজনীতির বাস্তবতায় থেকে একে অনেকে স্বপ্ন কল্পনা বলে হয়তো উড়িয়ে দেবেন। কিন্তু আমি বলব, স্বপ্ন না দেখলে তো সুন্দরের বাস্তবায়ন হয় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো বিস্ময়কর উন্নয়নের স্বপ্ন যদি না দেখতেন, তবে এসবের বাস্তবায়ন দেখে আমরা গর্বিত হতে পারতাম না।
বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের অনুষ্ঠানে গিয়ে রাজনীতির যে সুবাতাস দেখলাম; এর প্রেরণায় আমাদের অনুরোধ থাকবে-রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বদ্ধ অর্গল সব খুলে দিন। এতে অমন সুবাতাস বয়ে যাবে পুরো অঙ্গনজুড়ে। তেমন সুদিনেরই তো প্রতীক্ষা করে এ দেশের স্বাপ্নিক মানুষ।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
